
স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ১০ বছরের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, জেলও খেটেছেন ৩০ মাস। তবে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরও আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফেরার সুযোগ হয়নি সালমান বাটের। ২০১০ সালের আগস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টই হয়ে আছে তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এ নিয়ে আক্ষেপ–আফসোস থাকলেও কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়কের। জীবন একটা কেড়ে নিয়ে আরেকটা কিছু তো দিয়েছে, সেটা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট। কাল লাহোরে তারেক মাহমুদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাই অতীতে চলে গিয়েও দ্রুতই ফিরে আসতে চাইলেন বর্তমানে—
ক্রিকেটার হিসেবে তো আপনার ক্যারিয়ারটা আরও বেশি লম্বা হওয়া উচিত ছিল। ক্রিকেটার এবং অধিনায়ক হিসেবে দারুণ সম্ভাবনাময় ছিলেন। নেতৃত্ব পেয়েছিলেনও অনেক কম বয়সে। স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে হঠাৎই তো সব শেষ! আফসোস আছে কোনো এ নিয়ে?
সালমান: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, সেটা ভালো কিংবা খারাপই হোক, তা থেকে কিছু না কিছু শেখার থাকে। আমিও সেভাবেই অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি। দেখুন, যা ঘটেছে, সেটা অবশ্যই ভালো কিছু ছিল না। যেভাবে এরপর সবকিছু হলো, তা–ও হওয়া উচিত ছিল না। আমার সঙ্গেও অনেক কিছু ভালো হয়নি। কিন্তু জীবনকে এগিয়ে নিতে হবে, এটাই নিয়ম। মানুষ শিখে শিখেই সামনে এগোয়। এমন তো নয় যে আপনি ফেলে আসা সময়ে ফিরে গিয়ে সবকিছু আবার ঠিক করে দিয়ে আসতে পারবেন। আমিও সেরকমই সামনে এগিয়ে গেছি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা তো ওখানেই শেষ। ওই ঘটনা আপনার পরবর্তী জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
সালমান: হ্যাঁ, দেশের হয়ে আর খেলার সুযোগ পাইনি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছি, পিএসএল এবং আরও কয়েকটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও খেলেছি। কিন্তু এটা তো সবাই বোঝে, একজন ক্রিকেটারের মূল লক্ষ্যই থাকে জাতীয় দলে খেলা। আমারও সবসময় পাকিস্তানের হয়ে খেলারই লক্ষ্য ছিল। বাকি সবকিছু তো আমি সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, খেলে আসছি। পাকিস্তানের হয়ে খেলটা যেরকম হৃদয় থেকে আসে, সেটা আর কিছুতেই আসে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সুযোগ আর আসেনি। তবে আমি অন্য কিছু করেছি, সেখানে ভালোও করেছি।
আপনাদের সঙ্গে শাস্তি পাওয়া আরেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ আমির পরে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। আপনার সুযোগ হলো না কেন?
সালমান: সিদ্ধান্তটা নেওয়ার ভার পুরোপুরি পিসিবির ওপর ছিল। অন্য কোনো দিক থেকেই কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এ ক্ষেত্রে আইসিসির নিয়ম বা আইন আমাদের তিনজনের জন্য একই ছিল। আমাদের দলে নেবে কি নেবে না, সেটা ছিল পিসিবির ব্যাপার। আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব ভালো পারফর্ম করেছি, কিন্তু তারা হয়ত একটু অন্যভাবেই চিন্তা করেছে। আমির ছাড়াও এরকম আরও অনেক উদাহরণ পাবেন যারা ভুল করেছে, শাস্তি হয়েছে, পরে আবার খেলায় ফিরেছে। আমি হয়তো এর–ওর দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তে পারতাম…যাই হোক, কোনো অভিযোগ করছি না। এটা পুরোপুরি্ই পিসিবির সিদ্ধান্ত ছিল।
যখন অভিযোগ উঠল, নিষিদ্ধ হলেন, জেলে গেলেন… ওই সময় কোন জিনিসটা বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল? আপনার সব অর্জন ধুয়ে–মুছে গেল, আপনাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে…
সালমান: আসলে ওরকম পরিস্থিতিতে সব কিছুই চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। সবকিছুই কঠিন লাগে। কিন্তু আপনি জানেন একজন মুসলিম হিসেবে আমরা কোরআনকেই অনুসরণ করি। সেখানে বলা আছে, প্রতিটা কষ্টের পরই আনন্দময় কিছু আছে। সেটাই হলো আসল কথা। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কঠিন সময় গিয়েছে, সেটা আবার শেষও হয়ে গিয়েছে। আমি এখন ভালো আছি।
জেলের দিনগুলোতে কি অনুশোচনা হতো? জীবনের জন্য ইতিবাচক কিছু কি খুঁজে পেয়েছিলেন তখন?
সালমান: এখন আর সেই সময়ে ফিরে যাওয়ার কোনো অর্থ নেই। আমার কারও সহানুভূতির দরকার নেই, কারও কাছে কোনো কিছু প্রকাশ করারও দরকার নেই।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তরুণ ক্রিকেটারদের কোনো পরামর্শ কী দেবেন?
সালমান: দেখুন, আমি ওই বিষয়ে আর ফিরতে চাচ্ছি না এবং আপনাকেও অনুরোধ করব না ফিরতে। তার দরকারও নেই। খেলোয়াড়দেরকে যেটা ঠিক সেটাই করতে হবে। যে কাজগুলো তাদের করতে বলা হয় সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। আমি নিশ্চিত বাংলাদশে ক্রিকেট বোর্ড তাদের ক্রিকেটারদের এসব ব্যাপারে সচেতন করতে কাজ করে। আইসিসিও নিয়মিত তা করে। আমার কাছ থেকে আর না–ই বা শুনলেন (হাসি)।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভুলটা করল নির্বাচকেরা, অথচ আমরা দেখছি পরিবর্তন হচ্ছে খেলোয়াড়। এটা একটু অদ্ভূত, তাই না!পাকিস্তান দল নিয়ে সালমান বাট
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি প্রসঙ্গে আসি। ২৯ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে আইসিসির একটা আসর পেয়েও পাকিস্তান দল সেমিফাইনালে যেতে পারল না। এই ব্যর্থতাকে কিভাবে দেখেন?
সালমান: যেটা হয়েছে সেটা আসলে অপ্রত্যাশিত ছিল না। অপ্রত্যাশিত হলে সবাই এতে ধাক্কা খেত। দলে একজন মাত্র নিয়মিত স্পিনার, নিয়মিত ওপেনারও ছিল না। এমন চারজনকে ফেরানো হলো যারা প্রায় দুই বছর ওয়ানডেই খেলেনি। তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু চাওয়াটা বাড়াবাড়ি। দলের গঠনটাই ভুল ছিল। এরকম ফলাফল তাই অপ্রত্যাশিত নয়।
নিউজিল্যান্ড সফরের টি-টোয়েন্টি দলে সুযোগ পাননি বাবর-রিজওয়ানদের মতো অভিজ্ঞরা। শাহীন শাহ আফ্রিদিকে রাখা হয়নি ওয়ানডে দলে। টি-টোয়েন্টিতে নতুন অধিনায়ক করা হয়েছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ব্যর্থতার পর কী তাহলে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল পাকিস্তানের ক্রিকেট?
সালমান: (হাসি) চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভুলটা করল নির্বাচকেরা, অথচ আমরা দেখছি পরিবর্তন হচ্ছে খেলোয়াড়। এটা একটু অদ্ভূত, তাই না! আমরা দুবাইয়ে খেলতে গেলাম এক স্পিনার নিয়ে, এখন নিউজিল্যান্ডে যাচ্ছি তিন স্পিনার নিয়ে (হাসি)। এটারও কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। অধিনায়ক কাপড়-চোপড়ের মতো বদলে ফেলার জিনিস নয়। আপনি একজনকে দায়িত্ব দিলে তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। সে যেন দলে নিজের মতো করে পরিবেশ তৈরি করে নিতে পারে, দলের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারে। অনেক বেশি পরিবর্তন এনে এরকম অস্থিতিশীলতা তৈরি করা পাকিস্তানের ক্রিকেটের ক্ষতিই করছে। অনেক দিন ধরে এটাই হয়ে আসছে।
আমি কখনো বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের অংশ ছিলাম না, জানি না সেখানে কী ধরনের আলোচনা হয়। তারপরও বলি, দলটার প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজেদের আন্ডারডগ না ভাবা।বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে সালমান বাট
এত বছর পর একটা বড় টুর্নামেন্টের আয়োজক হয়েও পাকিস্তানে সব ম্যাচ হলো না। হাইব্রিড মডেলের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানকেও খেলতে হয়েছে দুবাইয়ে গিয়ে…
সালমান: বিশ্বের অন্য দলগুলো পাকিস্তানে এসে খেলছে, এটা চমৎকার। আপনি যেমন বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, অন্যান্য দেশ থেকেও অনেকে এসেছে। আমি নিশ্চিত, এখানকার সুযোগ–সুবিধায় আপনারা সন্তুষ্ট। ভালো লাগত যদি অন্যদের মতো ভারতীয় দলও পাকিস্তানে আসত। টুর্নামেন্ট খেলত, দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলত। একইভাবে পাকিস্তান দলও ভারতে যেত। কিন্তু ভারত সরকার এখনো তাদের দলকে পাকিস্তানে এসে খেলতে দিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। সবাই পাকিস্তানে খেলে আনন্দ পাচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক দেখছে; কিন্তু তারাই (ভারত) শুধু অন্যভাবে ভাবছে। ভারত এখানে আসে না বলে পাকিস্তানও এখন ভারতের বিপক্ষে অন্য জায়গায় ম্যাচ খেলবে। কী করার আছে!
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের খেলা দেখেও নিশ্চয়ই ভালো লাগেনি…
সালমান: বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কিন্তু উজ্জ্বলই মনে হয় আমার কাছে। দলে এখন যে অধিনায়ক, খুবই ভালো অধিনায়ক। মাঠে সে খুবই সক্রিয়, শরীরী ভাষা খুবই ভালো। সামনে হয়তো একটা পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে দলটা। কারণ অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার চলে যাচ্ছে। তরুণদের জন্য এটাই নিজেদের জায়গা পোক্ত করে নেওয়ার সময়। তবে দলটার মধ্যে প্রতিপক্ষকে আরও বেশি মরণকামড় দেওয়ার মানসিকতা দেখতে চাইব আমি। দেশের বাইরে তখন অনেক বেশি ম্যাচ জিতবে তারা। আমি মনে করি, সামর্থ্যের চেয়েও পিছিয়ে তাদের পারফরম্যান্স। আমি কখনো বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের অংশ ছিলাম না, জানি না সেখানে কী ধরনের আলোচনা হয়। তারপরও বলি, দলটার প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজেদের আন্ডারডগ না ভাবা।