
বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীরা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, নারী শিক্ষকের সংখ্যাও আশানুরূপ বাড়ছে না। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায়ও নারীদের অংশগ্রহণ এখনো সন্তোষজনক নয়। শিক্ষাবিদদের মতে, দারিদ্র্য, বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, নিরাপদ পরিবহনের অভাব এবং আবাসিক হোস্টেলের সংকট উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর ৫১ দশমিক ২১ শতাংশ। মাধ্যমিকে এই হার বেড়ে ৫৪ দশমিক ৮৪ শতাংশে পৌঁছায়। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে এসে এটি কমে ৫০ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে যায়। ২০২২ এবং ২০২১ সালের তথ্যেও দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও উচ্চ মাধ্যমিকে এসে এটি কমতে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪৭ শতাংশ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত যথাক্রমে ৫২ ও ৪৮ শতাংশ। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের সংখ্যা আরও কম। ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের সংখ্যা ৭১ শতাংশ, আর ছাত্রী মাত্র ২৯ শতাংশ।
কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা অনেক পিছিয়ে। ২০২৩ সালে ১০ হাজার ৫৯৫টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে মোট ১৮,১৮,৫২২ শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন ৫,৩৬,৯২৩ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল ২৭ দশমিক ১২ শতাংশ। নারী শিক্ষকের সংখ্যাও কম। ২০২৩ সালে ৫৫ হাজার ৩৩৮ জন কারিগরি শিক্ষকের মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র ১৩ হাজার ৫৭৫ জন, যা মোট শিক্ষকের ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
নারী শিক্ষকের সংখ্যা প্রাথমিক স্তরে তুলনামূলক বেশি হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় তা কম। ২০২৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৪২ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ১৫৩ জন ছিলেন নারী, যা মোট শিক্ষকের ৬২ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু মাধ্যমিকে এই হার নেমে আসে ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশে। উচ্চ মাধ্যমিকে তা আরও কমে ২৭ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা আরও কম। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬০ জন শিক্ষকের মধ্যে নারী ছিলেন ৪৪ হাজার ৮৭ জন, যা মোট শিক্ষকের ২৬ শতাংশের কিছু বেশি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৬ হাজার ৩৯৯ জন শিক্ষকের মধ্যে নারী ৪ হাজার ৪৬৯ জন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ হাজার ৫০৮ জন শিক্ষকের মধ্যে নারী ছিলেন ৫ হাজার ১৬৭ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ‘নারীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা সরকার ও পরিবারের দায়িত্ব। শিক্ষাক্ষেত্রে আইন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে মেয়েদের গ্রাম থেকে শহরে আসতে না হয়, গ্রামে থেকেই তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিয়েই মেয়েদের চূড়ান্ত গন্তব্য—এমন চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাবা-মাকে ছেলে-মেয়েকে সমান চোখে দেখতে হবে। নারীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হলে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীদের উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ কমার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, সামাজিক বাধা, বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, নিরাপদ পরিবহনের অভাব এবং হোস্টেল সংকট। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে পারলেও আর্থিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। শিক্ষাবিদদের মতে, সরকার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সহজ করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, আবাসন এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।