Image description
জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকা ইমানের দাবি

মুফতি আতিকুর রহমান

 ‘ঐক্যই শক্তি’, দুই শব্দের শক্তিশালী একটি প্রবাদ। এত ছোট বাক্যে বিশাল অর্থবহ প্রবাদ খুব কমই আছে অথবা নেই। কিন্তু এর বিশালত্ব ধারণ করার রীতি এ অঞ্চলের মানুষের স্বভাবে খুব একটা নেই। ব্রিটিশরা দুইশ বছর ‘ডিভাইডেড অ্যান্ড রুল’ তথা ‘বিভক্ত করো, শাসন করো’ নীতির মাধ্যমে এ অঞ্চলে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। ব্রিটিশরা চলে গেলও তাদের বিভক্তিকরণের প্রভাব এবং বিভক্ত হওয়ার স্বভাব বংশপরম্পরায় এখনো এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। এই প্রভাবে দেশ কিংবা দেশের বাইরের স্বার্থান্বেষী কিছু গোষ্ঠী এ দেশে এবং আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত মতভেদ ও বিভক্তির উপাদান-উপকরণ ঢেলে দিচ্ছে। ফলে পুরো জাতি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ ও রক্তপাত ব্যতীত কোনো দেশ দখল করা বা কোনো দেশের ওপর কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে কার্যকরী নীতি হলো বিভক্তিকরণ নীতি। আরেকটি বিখ্যাত প্রবাদ হলো, ‘ডিভাইড অ্যান্ড কনকোয়ার’ বা ‘বিভক্ত করো, জয় করো’। শত্রুদের মধ্যে পরস্পর বিভক্তি বা বিরোধ লাগিয়ে দিতে পারলে অস্ত্র না ধরেও যুদ্ধ বা দেশ জয় করা যায়। কেননা শত্রুদের মধ্যে বিভক্তি হওয়ার ফলে তারা নিজেরা নিজেরাই বিরোধে লিপ্ত হয়ে নিজেদের কর্র্তৃত্ব হারাবে। আর অপর পক্ষ জয়ী হবে। এটাকে বলা হয় কৌশলে বিজয় অর্জন। সুতরাং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প নেই।
 
ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ইমানের পর সবচেয়ে বেশি তাগিদ দেওয়া হয়েছে ঐক্যের ব্যাপারে। জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকা ইমানের দাবি। তাই বিভক্ত না হয়ে সংঘবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করাই ইসলামের নির্দেশনা। বিভক্ত হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠান, সমাজ, গোষ্ঠী ও দেশের প্রভাব ক্ষুণœ হয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমরা সবাই একই দেশের নাগরিক এবং একই জাতিসত্তার অধিকারী। জাতীয় স্বার্থে আমাদের সবচেয়ে গুরু দায়িত্ব হলো ঐক্যবদ্ধ থাকার মাধ্যমে বহির্বিশে^ দেশের প্রভাব অক্ষুণœ রাখা। তাহলে আমাদের দেশে কারও শকুনদৃষ্টি পড়বে না। সম্প্রতি দেশের স্বার্থে জাতীয় ঐক্য গঠনের বার্তা এসেছে। বিষয়টি যুগান্তকারী। এ ঐক্য ধরে রাখতে হবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কেননা দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ব্রিটিশদের প্রেতাত্মারা ‘ডিভাইডেড অ্যান্ড রুল’ বা ‘ডিভাইডেড অ্যান্ড কনকোয়ার’ নীতির জাল ফেলছে। আমরা সংঘবদ্ধ থাকলেই তাদের চক্রান্ত ভ-ুল হয়ে যাবে। সংঘবদ্ধভাবে থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। সেসব বর্ণনা থেকে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
 
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো (ঐক্যবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করো। তোমরা একে অপরের শত্রু ছিলে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরগুলো জুড়ে দিলেন, ফলে তার দয়ায় তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে।’ (সুরা আলে ইমরান ১০৩) মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সেসব লোকদের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা আলে ইমরান ১০৫)
 
মানুষ যখন বিভেদ জিইয়ে রাখে, তখন ধীরে ধীরে তাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় এবং শত্রুদের সামনে টিকে থাকা তাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর কলহ করো না। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে।’ (সুরা আনফাল ৪৬) অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে আল্লাহ ও রাসুলের ওপরই বিষয়টি ন্যস্ত করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ।’ (সুরা নিসা ৫৯) বিবদমান দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেওয়া অন্য মুসলমানদের দায়িত্ব। এই বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সব মুমিন ভাই ভাই। কাজেই তোমাদের ভাইদের মধ্যে শান্তি-সমঝোতা করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজুরাত ১০)
 
কখনো যদি বিভেদ চরমে পৌঁছায় এবং তা যুদ্ধ ও হানাহানিতে রূপ নেয়, তখন সবার জন্য সমঝোতার পথ অবলম্বন করা আবশ্যক। তবে সমঝোতার পরও কেউ সীমা লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের দুটি দল যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। এরপর তাদের এক দল যদি অন্য দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তবে বাড়াবাড়ি করা দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ তারা আল্লাহর ফায়সালার পথে ফিরে না আসে।’ (সুরা হুজুরাত ৯)
 
ঐক্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের এত নির্দেশনা থাকার পরও বর্তমানে মুসলিম সমাজে ঐক্যের অভাবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। আমাদেরকে নানা বিভক্তি থেকে বের হয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাসুল (সা.)-ও ঐক্যের বিষয়ে জোর তাগিদ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঐক্য বা সংঘবদ্ধতা ত্যাগ করে এক বিঘৎ পরিমাণ দূরে সরে গেছে সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেলেছে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজ আদায় এবং রোজা রাখা সত্ত্বেও? এর উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, নামাজ আদায় এবং রোজা রাখা ও মুসলমান বলে দাবি করা সত্ত্বেও।’ (সুনানে তিরমিজি) রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোত্তম অংশে বসবাস করে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে।’ (তিরমিজি)

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট