Image description
» সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ এবং সংসদের উচ্চকক্ষ নির্বাচন নিয়ে বিরোধ । » সব বিষয়ে সব দল একমত হতে হবে , এটা গণতান্ত্রিক ধারণা নয় : সালাহউদ্দিন আহমদ » যেখানে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল , সেখানে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি : আলী রীয়াজ

জুলাই সনদ চলতি মাসেই দেওয়া এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভাবনা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক পদ্ধতি সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন । সংস্কার প্রস্তাবের বেশির ভাগ দল মোটামুটি একমত হলেও দুটি বিষয়ে প্রায় অনড় অবস্থান নিয়েছে জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি ) । এতে সংলাপে বেশ ভালোই জট লেগেছে ।

যে দুই বিষয়ে বিএনপির প্রবল আপত্তি , তার একটি হলো সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য কমিটি গঠন , অন্যটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের গঠন পদ্ধতি ও এর এখতিয়ার । জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য কমিটি গঠনের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে । অনেক দল এ প্রস্তাব সমর্থন করেছে । কিন্তু বিএনপি সংবিধানে এই বিধান যুক্ত করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ।

দলটি মনে করছে, এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়ে সাংবিধানিক বিধিবিধান যুক্ত করা হলে তা নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার বেশ সীমিত করে দেবে । এতে যে দলই ভোটে জিতে আসুক , তাদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে । বিএনপির এ অবস্থান সমর্থন করছে ১২ দলীয় জোট , জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট , এনডিএম , জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও লেবার পার্টি । অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি , ইসলামী আন্দোলন , গণসংহতি আন্দোলন , এবি পার্টি , এলডিপি , সিপিবি , বাসদসহ সংলাপে অংশ নেওয়া বাকি ২৪ টি দল সংবিধানে নিয়োগ কমিটির বিধান চায় ।

জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে আইনসভার নিম্নকক্ষের সদস্য নির্বাচনের বর্তমান বিধান বহাল রেখে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করেছে ঐকমত্য কমিশন । এ প্রস্তাবটি অনেক দলের সমর্থন পেয়েছে । তবে বিএনপি বলছে , বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন একটি অবাস্তব ধারণা । দলটি বলেছে, সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা বিদ্যমান , সেটার মতোই নিম্নকক্ষে দলগুলোর প্রাপ্ত আসনসংখ্যার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন করা যেতে পারে ।

১২ দলীয় জোট , জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট , এনডিএম ও লেবার পার্টি বিএনপির এ ধারণা সমর্থন করছে । তবে সংলাপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দল বিএনপির এ ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে । জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উভয় কক্ষ চায় জামায়াতে ইসলামী , ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামপন্থী দলগুলো । এনসিপি , গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি , নাগরিক ঐক্য , গণঅধিকার পরিষদসহ ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষের দাবি করছে । অন্যদিকে সিপিবি ও বাসদ এক কক্ষের সংসদ রাখার পক্ষে । টানা সংলাপের পরও দলগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে বড় ধরনের ব্যবধান থেকে যাওয়ায় কমিশন এখন কৌশল বদলাতে শুরু করেছে । প্রকাশ্য সংলাপে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নেপথ্যে প্রভাবশালী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা চলছে । একই সঙ্গে জট যে যে প্রস্তাব নিয়ে লেগেছে , সেগুলোর মূল ধারণা ঠিক রেখে কিছুটা শিথিল করা যায় কি না , তা-ও বিবেচনা করা হচ্ছে ।

সংলাপ প্রায় অচলাবস্থা দেখা দেওয়ার পর্যায়ে গড়ালেও আশা ছাড়ছেন না ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ । এ পর্যন্ত কতটুকু এগোনো গেল , আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন , “যেখানে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল , সেখানে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি । আমরা আশাবাদী , রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভূমিকা বুঝতে পারবে । ”

রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের আলোচনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে , সেগুলো হলো — প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ , সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠন , জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন , বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ , তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে আবার যুক্ত করা , রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া এবং একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন , সেসব । একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন । দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় এক ব্যক্তির জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য হয়েছে । তবে বিএনপি বলেছে , সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে কমিটি গঠনের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হলে এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার বিষয়ে দেওয়া সমর্থন প্রত্যাহার করবে তারা ।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতি থেকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে । এ ছাড়া আইনসভায় উভয় কক্ষের দুই তৃতীয়াংশে ভোটে সংবিধান সংশোধনের বিধান সুপারিশ করেছে কমিশন । তবে বিএনপি বলছে , দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো দল ৫০ শতাংশ ভোট পায় না । সে ক্ষেত্রে দুই - তৃতীয়াংশের এ বিধান থাকলে প্রয়োজন হলেও সংবিধান সংশোধন করা যাবে না । বিএনপির হয়ে সংলাপে নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ । তিনি বলেন , সব বিষয়ে সব দল একমত হতে হবে , এটা গণতান্ত্রিক ধারণা নয় । ভিন্নমত থাকতেই পারে । দেখতে হবে বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের বাস্তবতা

বিবেচনায় নিয়ে দলীয় অবস্থান ঠিক করা হচ্ছে কি না । সংলাপে এ পর্যন্ত দুই ধাপে ৫২ টি অধিবেশনে কথা হয়েছে । প্রথম ধাপে পৃথকভাবে ৩৩ টি দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫ টি অধিবেশনে কমিশন মতবিনিময় করেছে । দ্বিতীয় ধাপে সব দল ও জোটের সঙ্গে একসঙ্গে আলোচনা চলছে । আজ বুধবার দ্বিতীয় ধাপের অষ্টম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে । তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি , নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ , রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনসহ কিছু বিষয়ে আজ আলোচনা হতে পারে ।

কমিশনের ভেতরকার অনুযায়ী , বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনতে কমিশন সোম ও মঙ্গলবার বড় দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সরাসরি বা ভার্চুয়ালি কথা বলেছে । সরকারের একজন উপদেষ্টাও দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন । কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে শিগগির সরাসরি বৈঠকও হতে পারে । আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কমিশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । তবে সংস্কারে ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় দলগুলোর অনুদার মনোভাবে ঐকমত্য কমিশনের অনেকে বিরক্ত । আবার কিছু রাজনৈতিক দলের অবস্থানে বিস্মিত হয়েছেন কমিশনের কেউ কেউ । একজন প্রভাবশালী সদস্য মনে করছেন , ভোটের হিসাবনিকাশের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকায় বাম সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে বেরোচ্ছে না । অন্যদিকে ভোটে কিছুটা এগিয়ে থাকার আশা থেকে কয়েকটি ইসলামপন্থী দল তুলনামূলক উদার মনোভাব দেখাচ্ছে । রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের আত্মজিজ্ঞাসার তাগিদ দিয়ে আলী রীয়াজ বলেন , এখন জুলাই মাস , প্রত্যেকের স্মৃতিতে গত বছরের জুলাই ও ১৬ বছরের দুঃশাসন ।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের কর্মীদের কাছে জিজ্ঞেস করা — কতটা নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাঁরা গেছেন । ৫৩ বছরে যে সুযোগ সবাই পেয়েছেন , দেশের মানুষ ও যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন , তাঁরা যে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন , সে দায়িত্ব সহজে আসেনি । কিন্তু দায়িত্ব সবাই পালন করছেন কি না , সে প্রশ্ন নিজেদের করা উচিত । কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন , কিছু কিছু বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে । বাকি বিষয়ে আলাপ হচ্ছে । কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেলে একটা জাতীয় সনদ প্রণয়ন ও স্বাক্ষর হবে । তিনি বলেন , যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে , তা ব্যর্থ হোক , কেউ চায় না । আর যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন , রক্ত দিয়েছেন , তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে কেউ চায় না ।