
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে , ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত ট্রেনে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১০ টি । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ছিলেন রেলকর্মী বা রেলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি । এসব ঘটনায় মামলা হলেও বিচারপ্রক্রিয়ার গতি ধীর । অনেক ক্ষেত্রে বিচারের মুখ দেখেননি ভুক্তভোগীরা ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে ট্রেনের টয়লেটে । এরপর খাবার বগিতে । অনেক নারীই সম্মানহানির ভয়ে যৌন হয়রানির বিষয়টি চেপে রাখার চেষ্টা করেন । তবে কেউ কেউ আবার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন । সে ঘটনাগুলোই মূলত সামনে আসছে । রেলের অস্থায়ী কর্মচারীরা এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটাচ্ছেন বলে তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । তাঁদের হাতে যাত্রীরা নিরাপদ কি না , এ প্রশ্ন তুলেছে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও ব্যক্তিরা ।
গণপরিবহনের যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো . মোজাম্মেল হক চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন , রেলে জিআরপি এবং আরএনবির মতো দুটি বাহিনী কাজ করছে । কিন্তু যাত্রীরা তারপরও নিরাপদ নয় । ট্রেনে শুধু মালপত্র চুরি নয় , ধর্ষণ ও ডাকাতির মতো বড় অপরাধের ঘটনা ঘটছে । ডাকাতির সময় যাত্রীকে শ্বাস রোধ করে মেরে বাইরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে । ফলে যাত্রীরা ট্রেনে অনিরাপদ । যাঁরা যাত্রী ও রেললাইনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত , নিরাপত্তাহীনতায় ট্রেনযাত্রীরা তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে । মামলা ও শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ কমবে । চুরি , ছিনতাই নিয়মিত ঘটনা চলন্ত ট্রেনে যাত্রীদের মালামাল চুরি , মোবাইল ছিনতাইয়ের অভিযোগ নিয়মিত পাওয়া যায় ।
একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেছেন , অনেক সময় অপরিচিত লোক ট্রেনের কামরায় ঢুকে টিকিটধারী বৈধ যাত্রীর আসনকে নিজের দাবি করে হুমকি - ধমকি দেয় । একপর্যায়ে ব্যাগ বা মোবাইল কেড়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় । ছুরি ঠেকিয়েও লুট করা হয় । যাত্রীদের ট্রেনের দরজা দিয়ে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে । গত বৃহস্পতিবার রাজধানী তথা দেশের প্রধান রেলস্টেশন কমলাপুরে ঘুরে শিথিল নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখা যায় । টিকিট ছাড়া যাত্রীরা অনায়াসে স্টেশনে প্রবেশ করছিল । টিকিটহীন বা উটকো লোকের প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ ঠেকানোর কোনো তৎপরতা নেই । এ ছাড়া ট্রেনে নির্বিঘ্নে উঠছিল হকার ।
কয়েকজন যাত্রী বললেন , হকারসহ অনাকাঙ্ক্ষিত এসব লোকজনের উপস্থিতি শুধু বিরক্তিকর না , তা নিরাপত্তার দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য । সুমি হালদার নামের রেলের এক নিয়মিত যাত্রী এ সময় বলেন , ' ট্রেনযাত্রা এখন অনেকটা আতঙ্কের বিষয়েই পরিণত হয়েছে । এসি চেয়ারেও অযাচিত লোক ঘোরাফেরা করে । আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকদের দেখা যায় না বললেই চলে । যা দু - একজন থাকে , তাদের বিনা টিকিটের যাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখি । ’
পাথর ছোড়াও বন্ধ হচ্ছে না রেলযাত্রার আরেক পুরোনো সমস্যা লাইনের পাশ থেকে লোকজনের চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারা । এ ঘটনায় বহু যাত্রী আহত হয়েছে চোখে - মুখে পাথর বা জানালার ভাঙা কাচ লেগে । ঘটনার পরপর বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনাও আছে । ট্রেনে দায়িত্বরত গার্ড , চালক , পুলিশসহ অন্য কর্মীদেরও আহত হওয়ার নজির আছে । ২০১৩ সালে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া ঢিলে প্রীতি দাস নামের একজন প্রকৌশলীর মৃত্যু হয় ।
প্রাপ্ত তথ্যমতে , শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৫০ টির বেশি । রেল কর্তৃপক্ষের প্রচারণা , আবেদন - নিবেদন , অপরাধী ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণা ইত্যাদির পরও এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই । রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারা অনুযায়ী , ট্রেনে পাথর ছোড়ার শাস্তি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা । পাথর নিক্ষেপে কারও মৃত্যু হলে ৩০২ ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে । তবে পাথর ছোড়ার জন্য এ আইনে কারও শাস্তির কোনো নজির নেই বলেই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ।
নিরাপত্তার অপ্রতুল ব্যবস্থা সারা দেশে বর্তমানে মোট ৩৮৮ টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলে । এর মধ্যে ১০৬ টি আন্তনগর ট্রেন , ১৮০ টি মেইল ও কমিউটার ট্রেন এবং ১০২ টি লোকাল ট্রেন । প্রতিদিন হাজারো মানুষ এসব ট্রেনে যাতায়াত করে । আন্তনগর ট্রেনে রেল পুলিশের তিনজন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন । তাঁদের কাজ যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা ও মালামালের দেখভাল করা । শত শত যাত্রীবাহী অনেকগুলো কামরার পুরো একটি ট্রেনে ৩ জন পুলিশ সদস্য কতটা নিরাপত্তা দিতে পারেন , এ নিয়ে যাত্রীরা প্রশ্ন তুলেছে । তার ওপর একই পথে চলাচল করা মেইল , কমিউটার ও লোকাল ট্রেনগুলোয় এ ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেই । ফলে মূলত এসব ট্রেনেই অপরাধ ঘটছে । কিছু ট্রেনে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে , যার অনেকগুলোই নষ্ট বা অকার্যকর । ৪৬৬ টি রেলস্টেশনের মধ্যে সিসিটিভি আছে মাত্র ৩৭ শতাংশ স্টেশনে ।
কর্মকর্তারা যা বললেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো . আফজাল হোসেন গত বৃহস্পতিবার বলেন , “ ট্রেনে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রেল পুলিশের ( জিআরপি ) । আমাদের সুপারিশ ছিল , প্রতিটি ট্রেনে অন্তত পাঁচজন পুলিশ সদস্য রাখার , যদিও তা - ও সে অর্থে পর্যাপ্ত নয় । যাত্রী নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে আমরা জিআরপিকে বলব । রেলের নিরাপত্তা বাহিনী ( আরএনবি ) মূলত রেলওয়ের স্থাপনাসমূহ ও সম্পদ রক্ষায় কাজ করে । ট্রেনের ভেতরে যাত্রী নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনের দায়িত্ব জিআরপির ওপরই বর্তায় । তবে রেলের জনবলসংকট রয়েছে । তাই কিছু জায়গায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে অস্থায়ী জনবল দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে । '
রেল পুলিশের উপমহাপরিদর্শক ( ডিআইজি ) বি এম হারুন - অর - রশিদ বলেন , ‘ সারা দেশে অনেকগুলো ট্রেন চলাচল করে । সব ট্রেনে ৩-৪ জন পুলিশ সদস্য দেওয়া সম্ভব হয় না । কারণ , আমাদের লোকবলের সংকট আছে । আর একটি ট্রেনে মাত্র ৩ জন পুলিশ দিয়েও নিরাপত্তা দেওয়া যায় না । ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তায় কিছুটা তো ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে । তবে সীমাবদ্ধতা থাকলেও যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি । '