Image description

এখন থেকে তিন দশক আগে বাংলা ভাষা অনলাইন মাধ্যমে পাঠ খুবই দুষ্কর ছিল। এমনকি অফলাইনে একটি ডিভাইসে লেখা বাংলা ভাষা অন্য ডিভাইসে গেলে ফন্ট ভেঙে যেত। নানা জটিল প্রক্রিয়ার বিকল্প পদ্ধতিতে বাংলাকে ইন্টারনেটে পাঠ উপযোগী করতে হতো।

নব্বইয়ের দশকের দিকে বাংলাভাষা ইউনিকোড মান ব্যবহারের পর সহজবোধ্য হয়। পরে ইন্টারনেটে বাংলা হরফে লেখার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে অভ্র সফটওয়্যার। তিন তরুণের হাত ধরে এই উদ্যোগ বাংলা ভাষাকে অনলাইন জগতে যুক্ত করেছে।

অবশ্য অভ্র ছাড়াও অন্যান্য সফটওয়ারে বাংলা ইউনিকোড প্রচলিত রয়েছে। তবে, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগানে বিনামূল্যে সফটওয়্যারটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছে অভ্র। অভ্রর কি-বোর্ড তৈরির কারিগর মেহদী হাসান খানসহ তার তিন বন্ধু। অন্যরা হলেন রিফাত নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম ও শাবাব মুস্তাফা।

বাংলা ইউনিকোড কি-বোর্ড বিনামূল্যে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের সরবরাহের জন্য এবার স্বীকৃতি পেয়েছেন মেহেদী হাসানসহ তার বন্ধুরা। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একুশে দিয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস তাদেরসহ অন্যদের একুশে পদক দেন।

ডিজিটাল সিস্টেমে কোনো ভাষালিপির এনকোডিং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলেই সেই ভাষায় ইন্টারনেটে বিশ্বব্যাপী তথ্য বিনিময় করা যায়। আর এটি মূলত ইউনিকোড প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হওয়ার পরে নানা ধাপ ও সংস্কারের মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। বর্তমানে ইউনিকোডে বাংলা ভাষা একটি সমৃদ্ধ ভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কম্পিউটার আসার পরে লেখার সনাতনী পদ্ধতি ছিল অ্যাস্কিকোডভিত্তিক। সে সময় লেখার ফন্ট ছিল পুরোনো। সেই ফন্টে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইটে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা যেত না। লেখা গেলেও সেটা ভেঙে যেত বা এক ডিভাইসের ফন্ট অন্য ডিভাইসে গেলে তা পাঠের অযোগ্য হয়ে যেত। ফন্টের সর্বজনীন কারিগরি ব্যবস্থা ‘ইউনিকোড’ আসার পর এই জটিলতা দূর হয়ে বর্তমানে এটি ব্যবহারকারীদের কাছে আরো সহজবোধ্য হয়েছে।

ইউনিকোডে লেখা ভেঙে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিসিসির পরামর্শক, ভাষা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মামুন অর রশীদ আমার দেশকে বলেন, কম্পিউটারে ইউনিকোডে ফন্ট ভেঙে যাওয়ার বিষয়টা কয়েকটি কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে। যেমন- কম্পিউটারের ইনপুট মেথড কী, কোন ধরনের কি-বোর্ড দিয়ে লেখা হচ্ছে সেটার ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে আধুনিক অনেক ডিভাইসে ভয়েস দিয়েও টাইপ করা যায়।

ইউনিকোডে লেখার সময় লেখাটি কোন ফন্টে আছে সেটাও বিবেচ্য বিষয় বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ। তিনি জানান, এক ফন্টের লেখা অন্য ফন্টে দিলে ভেঙে যায়। ইউনিকোডের লেখাটি কোন ধরনের ডিভাইসে লেখা হচ্ছে- এটি ল্যাপটপ, কম্পিউটার নাকি মোবাইলে লেখা হচ্ছে সেটা বিবেচ্য বিষয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, লেখাটি কোন অ্যাপ্লিকেশন বা উইন্ডোজে লেখা হচ্ছে। কারণ, উইন্ডোজভেদে লেখার ফন্ট পরিবর্তন হয় ও ভেঙে যায়।

তবে বর্তমানে ইউনিকোডের মাধ্যমে বাংলা লেখাগুলো ওয়েবসাইট কিংবা বিভিন্ন ডিভাইসে টাইপ করা হলেও খুব বেশি ভাঙে না। আর যদি কিছু ক্ষেত্রে ভেঙেও যায় তার দায় ইউনিকোডের নয় বলে জানান অধ্যাপক মামুন। তিনি বলেন, ইউনিকোডে বাংলা ভাষা এখন মোটামুটি স্থায়ী একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য বাংলা ভাষার অন্য ইউনিকোডগুলোকে স্ট্যান্ডারাইজড করা। বর্তমানে বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ ইউনিকোড আছে। এ ছাড়া ইউনিকোডে ১৬টি সংস্করণ এসেছে। ইউনিকোডে বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা আমাদের জায়গায় এখন সন্তুষ্ট।

তবে ইউনিকোডে বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপি তৈরির আগে লেখা ভেঙে যাওয়ার সমস্যা প্রকট ছিল। ১৯৯১ সালে ইউনিকোডে বিভিন্ন ভাষা যুক্ত হওয়া শুরু হলেও বাংলাদেশের এর সঙ্গে যুক্ত হতে দুই দশক সময় লাগে। বাংলাদেশ ২০১০ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে নিজস্ব ভাষার স্ট্যান্ডারাইজড সম্পূর্ণ ঠিক না করে কোনোরকমে গিয়ে ইউনিকোডে যুক্ত হয়। ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম ইউনিকোডে বাংলা ভাষার সাংকেতিক ব্যবস্থা বা কোডসেট রাখে ভারতের হিন্দি লিপি ‘দেবনাগরী’র অনুকরণে।

বাংলা ভাষায় ইউকোড মানের জন্য অভ্রর ভূমিকা প্রশ্নে অধ্যাপক মামুন বলেন, বিজয়ের ইউনিকোড সফটওয়্যারটি অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করতে হয়। সেখানে অভ্র আমাদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সব বাংলা ভাষাভাষীর জন্য একটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তাদের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ বাংলা হরফে বিশ্বকে চেনার পথ সুগম করে দিয়েছে।

ইউনিকোড নিয়ে কাজ করা বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমানে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল মনসুর মুহম্মদ আবু মুসা আমার দেশকে বলেন, ইউনিকোডে যুক্ত হওয়ার আগে ভাষার মান ঠিক করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ভাষার মান ঠিক করার মতো তখন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। পরে উপায়ান্তর না দেখে আমরা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মাধ্যমে কোনোরকমে একটা মান ঠিক করে ইউনিকোডে যুক্ত হই।

জানা যায়, বাংলাদেশ যখন ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হয় তখন ড়, ঢ়, য় ও ৎ- এই চারটি বর্ণ ইউনিকোডে ছিল না। তবে পরে ধাপে ধাপে এটি যুক্ত করা হয়। সে সময় বর্ণগুলো লিখতে ড, ঢ ও য-এর নিচে নোকতা অর্থাৎ বাড়তি একটা ডট (.) দিতে হতো। এ ছাড়া আগে টাইপ করার সময়ে এ-কার, ই-কার, ঈ-কার বর্ণের আগে না করে পরে টাইপ করতে হতো। ফলে টাইপ করতে গিয়ে অনেকে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হতো। এ ধরনের বেশ কিছু বিষয় ২০২২ সালে ইউনিকোডের ১৫তম সংস্করণে সমাধান হয়েছে।

তবে বর্তমানেও ইউনিকোডে বাংলার কিছু বর্ণে সমস্যা রয়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর। তিনি বলেন, আমাদের য়, ড়, ঢ়, ৎ এই বর্ণগুলোকে একাধিক কোড বা চিহ্ন হিসেবে ইউনিকোডে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে, যখন একজাতীয় ফন্ট অন্য ফন্টে রূপান্তর করা হয়, তখন অনেক বর্ণ ভেঙে যায়।

এ ছাড়া এ-কার বা ঐ-কার লিখতে গেলে শুরুতে মাত্রা নিয়ে সমস্যা হয়। য, র-এর সঙ্গে রেফ বা য-ফলা যোগ করতে সমস্যা হয়। যথাযথভাবে ড্যাশ, উদ্ধৃতিচিহ্ন পাওয়া যায় না। যুক্তবর্ণকে স্বচ্ছ করার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। ইউনিকোডেও বর্ণ স্বচ্ছ হয়নি। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইউনিকোড নিয়ে যারা কাজ করবেন তাদের সঙ্গে বাংলা লিপি ও বানান বিশারদকে যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

ইউনিকোড ফন্টের সমস্যা দূর করা সম্ভব না হলে কিছু শব্দের বানান সংকট আরো বাড়বে। পাশাপাশি ভাষা ব্যবহারকারীর অন্য হরফের ওপর নির্ভরতা বাড়তে পারে আশঙ্কা করে অধ্যাপক তারিক মনজুর আরো বলেন, বাংলা বানানের ভুল ধরার কাজে এখনো আমরা যথেষ্ট মাত্রায় প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারিনি। তিনি মনে করেন, ইউনিকোডের সুবিধা নিয়ে বাংলা শব্দের ডিজিটাল উচ্চারণ অভিধান তৈরি করারও সময় এসেছে।

ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যতগুলো সংস্কার বা সংশোধনীর প্রস্তাবের ৫০ শতাংশ কার্যকর সম্ভবপর হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মামুন অর রশীদ বলেন, বাংলা ভাষার অনেক সমস্যার সমাধান এরই মধ্যে হয়েছে। তবে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত যতিচিহ্ন দাঁড়ির বদলে এখনো অনেক ক্ষেত্রে দেবনাগরী বর্ণমালার মোটা ও দীর্ঘ দাঁড়ি আসে। এটার পুরোপুরি সমাধান এখনো হয়নি। কারণ, আমাদের দাঁড়ির পরিবর্তে চার্টে এখনো দেবনাগরী দাঁড়ি রয়েছে। অবশ্য ফন্টে লিখলে এই দাঁড়ির সমস্যাটাও খুব বেশি হয় না।

তিনি আরো বলেন, বাংলা ভাষার বাকি ৫০ শতাংশ সংস্কার ও সংশোধন ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম করবে না। কারণ, এখন কোনো বর্ণ বা হরফ পরিবর্তন করতে গেল আগের সব লেখার হরফ বা বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তখন লেখাগুলোকে বক্স বক্স আকারে দেখা যাবে। যেটা নতুন বিড়ম্বনা তৈরি করবে।

অবশ্য ইউনিকোডে বাংলা ভাষার সমস্যা দূর করে নতুন আরেকটি ফন্ট চালু করেছে কম্পিউটার কাউন্সিল। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (ইবিএলআইসিটি) প্রকল্পের অধীনে ‘পূর্ণ’ নামের পরিপূর্ণ একটি বাংলা ফন্ট তৈরির কাজ শুরু করে। পরে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ফন্টটি উদ্বোধন করা হয়। বিসিসি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমিসহ অংশীজনদের নিয়ে একটি ফ্রেমওয়ার্ক করা হবে, যাতে তারা ‘পূর্ণ’ ফন্টটি ব্যবহার করে।