Image description
 

ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকের কথা। দীর্ঘমেয়াদি ও সহনীয় সুদহারে ঋণের জন্য নির্ভরযোগ্য ও গ্রাহকবান্ধব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভাব বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করছিলেন ফ্রান্সের দরিদ্র কৃষকরা।

 

ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকের কথা। দীর্ঘমেয়াদি ও সহনীয় সুদহারে ঋণের জন্য নির্ভরযোগ্য ও গ্রাহকবান্ধব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভাব বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করছিলেন ফ্রান্সের দরিদ্র কৃষকরা। এমন পরিস্থিতিতে ১৮৯৪ সালে কৃষি সমবায়ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা করে ক্রেডিট অ্যাগ্রিকোল। পরে গোটা ফ্রান্সেই কৃষি সমবায়ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটে প্রতিষ্ঠানটির। কাজের পরিধি ক্রমেই বাড়তে বাড়তে ১৯৭৬ সালে এটি হয়ে ওঠে পুরোদস্তুর এক ব্যাংকিং করপোরেশন। বর্তমানে গোটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমবায়ভিত্তিক করপোরেশনে রূপ নিয়েছে ক্রেডিট অ্যাগ্রিকোল। ওয়ার্ল্ড কো-অপারেটিভ মনিটর ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ছিল ১১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমবায়ভিত্তিক করপোরেশন জার্মানিভিত্তিক আরইডব্লিউই গ্রুপ। ১৯২৭ সালে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটির আওতায় সুপারশপ আছে ৩ হাজার ৩০০টিরও বেশি। মাত্র ১৭ জন নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির কর্মীসংখ্যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজারে। ২০২৩ সালের মধ্যেই এ সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির মোট বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৮২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

ব্রাজিলের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি সমবায়। সেখানকার কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুঁজির সংস্থানে বড় ভূমিকা রাখছে সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সমবায়ের উপস্থিতি দেখা যায় দেশটিতে। ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ অ্যালায়েন্সের তথ্যমতে, বার্ষিক টার্নওভারের দিক দিয়ে ২০২৩ সালে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি টার্নওভার ছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়। শিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি ছিল স্পেনে। রিটেইল ও ইন্স্যুরেন্স খাতে জার্মানিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে ব্রাজিলে।

 

জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা পালন করেছে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো। পারস্পরিক সহায়তা ও অর্থায়ন মডেলের ভিত্তিতে এসব দেশের কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মাঝারি থেকে বৃহৎ শিল্পের বিকাশেও ভূমিকা রাখছে সমবায় মডেল। এমনকি এখন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় সফল উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত শতবর্ষী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শুরু হয়েছিল সমবায়কে কেন্দ্র করেই।

 

বাংলাদেশে সমবায়ভিত্তিক আর্থিক, বাজার বিপণন ও কৃষিপণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয় স্বাধীনতারও আগে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে সমবায়ভিত্তিক মডেলে সফলতার নিদর্শন খুব একটা তৈরি হয়নি। বরং এ ধরনের উদ্যোগ বড় হওয়ার জায়গাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। বর্তমানে বাজার বা ছোট কারবারভিত্তিক ছোট ছোট অনেক সমবায় থাকলেও এগুলোকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক শক্তি ও ভিত্তি গঠনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি।

এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের বক্তব্য হলো বাংলাদেশে সমবায়ের ধারণা খুব একটা এগোয়নি। বিষয়টিতে উদ্ভাবনীশক্তির প্রয়োগ বা নতুনত্ব বের করার চেষ্টাও এখন তেমন একটা দেখা যায় না। রয়েছে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাও। তাছাড়া দেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামোও সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগগুলোর সম্প্রসারণের বড় বাধা। নীতিগতভাবেও রয়েছে প্রণোদনার অভাব।

ষাটের দশকে বাংলাদেশে ড. আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন গবেষক মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেশে পল্লী উন্নয়নের উপযোগী সমবায়ভিত্তিক কিছু মডেল কর্মসূচি উদ্ভাবন করা হয়। পুঁজি তৈরি, সংগঠন সৃষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মতো নয়টি অগ্রাধিকার নিয়ে বার্ড শুরু থেকেই সমন্বিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করে। দেশ-বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন কর্মীরা কুমিল্লায় এসে ‘বার্ড মডেল’ সম্পর্কে ধারণা নিতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমবায় মালিকানাকে গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বর্তমানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে বার্ড। পল্লী উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বার্ড ১৯৮৬ সালে ‘স্বাধীনতা পদকও লাভ করে। কিন্তু সরকারের যথাযথ সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বার্ড মডেল সামনে থাকলেও দেশে পরে আর কোনো শক্তিশালী সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। সমবায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, সমবায়ের ধারণাকে এগিয়ে নিতে পরে আর কাজ করা হয়নি। নতুন কোনো উদ্ভাবনী ধারণাও তৈরি করা যায়নি।

এ বিষয়ে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বার্ড একটি ধারণা ছিল। কিন্তু এটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য পরে আর কাজ করা হয়নি। এখান থেকে নতুনত্ব বের করার চেষ্টা করা হয়নি। তাই এ ধারণা পূর্ণতা পায়নি। তাছাড়া এখানে অনেকে নিয়মের মধ্যে থাকতে চায় না। তাই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাও রয়েছে।’

সমবায় অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে এখন সমবায় সমিতির সংখ্যা ১ লাখ ৮২ হাজারের বেশি। যেখানে যুক্ত রয়েছে দেশের ১ কোটি ২৪ লাখ মানুষ। অর্থাৎ প্রতি ১৫ জনের মধ্যে একজন কোনো না কোনো সমবায়ে যুক্ত রয়েছেন। তবে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমিতিগুলোয় সংরক্ষিত সঞ্চয় আমানতের পরিমাণ মাত্র ১ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। সব সমিতির সঞ্চয় আমানতের সম্মিলিত পরিমাণ ২০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা।

সমবায়ে মাঠ পর্যায়ের চ্যালেঞ্জগুলো প্রসঙ্গে উন্নয়ন সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক একেএম মাসুদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দরিদ্র মানুষের সংগঠনগুলোকে সহজে নিবন্ধন করার ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো প্রভাবশালীরা নেতৃত্বে চলে আসে। সমবায়কে অর্থনীতির অংশ হিসেবে না দেখলে এটা সফল হবে না। এজন্য উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন সমবায় কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নেও সমবায় অনেক পিছিয়ে আছে। সমবায়ে একটি সমতাভিত্তিক সংগঠন হিসেবে মালিকানার সমতা নিশ্চিত করা না গেলে এটা ব্যর্থ হবে।’

রাজশাহীভিত্তিক সংস্থা রুলফাওয়ের নির্বাহী পরিচালক আফজাল হোসেন মনে করছেন, প্রান্তিক মানুষদের সমবায়ের অনুশীলনে আনতে ঋণ সহায়তা দরকার। তিনি বলেন, ‘তাদের পুঁজি কম, তাই সরকারি অফিসে গেলে তারা গুরুত্ব পায় না। ২০ জনের কম হলে সমবায় করতে পারে না। তাই আইন সহজগম্য করতে হবে।’

দেশে এখন সফল সমবায় বলতে মিল্ক ভিটা ছাড়া তেমন কোনো আদর্শ উদাহরণ সামনে নেই। প্রতিষ্ঠানটির কাজ করে শুধু দুগ্ধজাত পণ্য নিয়ে। বর্তমানে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে না। বাড়ছে না ব্যবসার আকার বা পরিধি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ২২১ কোটি টাকা।

দেশের ১২টি জেলায় কাজ করছে সমবায় প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)। এ সমবায়ে যুক্ত রয়েছে ২ হাজার ৩৬৩ জন। এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুরু থেকেই এখানে সমবায় নিয়ে অবহেলা দেখা যাচ্ছে। বিদ্যমান আইনি কাঠামো সমবায়কে নিরুৎসাহিত করছে। আইন দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক খবরদারির মাধ্যমে আমলারা অন্যায় সুবিধা নিচ্ছেন। তাই গত অর্ধশতকে সমবায় অর্থনীতিতে তেমন একটা প্রভাব রাখতে পারেনি। তবে এশিয়ার অনেক দেশে সমবায় সফল হয়েছে সেখানকার সমবায়বান্ধব আইনকাঠামোর কারণে। নগর দরিদ্রতা কমিয়ে আনতে সমবায়কে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। ব্যাংক কৃষি ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সমবায়কে অগ্রাধিকার দিলে এটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। গ্রামাঞ্চলে এখন সমবায় অন্যতম প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’