রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এই সমঝোতার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও এনসিপি নেতৃত্ব জোর দিয়ে বলছে—এই জোটের কেন্দ্রবিন্দুতে কোনো আদর্শগত আপস নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারই রয়েছে।
দলটির নেতাদের মতে, তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং আসন্ন গণভোটে 'হ্যাঁ' ভোটের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করা।
এনসিপির দাবি, এই সংস্কার কর্মসূচিতে জামায়াত ও তাদের মিত্র দলগুলো সমর্থন দিচ্ছে, অথচ বিএনপি ধীরে ধীরে একটি সংস্কারবিরোধী অবস্থানে চলে গেছে।
এনসিপির বিশ্বাস, সংস্কারের পক্ষে থাকা ভোটগুলো যদি এক ব্যালটে আনা যায়, তাহলে গণভোটে 'হ্যাঁ' ভোটের জয় সহজ হবে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হবে।
গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, জামায়াতের নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোটে যোগ দেওয়া পুরোপুরি একটি নির্বাচনী সমঝোতা, কোনো আদর্শিক ঐক্যের প্রশ্ন নেই।
তিনি জানান, এনসিপি শুরুতে এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় পরিবর্তন এসেছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, 'এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝেছি, আধিপত্যবাদী আগ্রাসন শক্তি এখনো সক্রিয়। তারা এখনো চক্রান্ত করছে নির্বাচন বানচাল করতে।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, গণতান্ত্রিক জোটের ভেতরে থেকে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমরা রাজনৈতিকভাবে একমত হয়েছি। এর ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক সমঝোতা বাস্তবায়নে আট থেকে দশটি দলের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হবে।
তিনি আরও বলেন, একই সঙ্গে আমরা জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচার, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন, আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাইকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে পারব। এই কারণেই আমরা জোটের পথে এগিয়েছি।
গতকাল প্রায় ১৩০ জন এনসিপি নেতা দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কাছে একটি সমর্থনপত্র জমা দেন। সেখানে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতি সংহতি ও সমর্থন জানানো হয়।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, সারোয়ার তুষার, ড. আতিক মুজাহিদ, জাভেদ রাসীন, সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া ও এহতেশাম হক; যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুল রহমান তুহিন; সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দারসহ আরও অনেকে।
চিঠিতে তারা লেখেন, 'দলীয় স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে এনসিপি যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা কিংবা জোট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সে বিষয়ে আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সম্মতি রয়েছে।'
তারা আশা প্রকাশ করেন, দূরদর্শী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে আহ্বায়ক (নাহিদ ইসলাম) দলকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাখবেন এবং জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় করবেন।
সারোয়ার তুষার এই প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপির সঙ্গে জোট আলোচনা ভেস্তে গেছে, কারণ 'ঐকমত্য ও জোট গড়ে ওঠে দল হিসেবে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক পছন্দের ভিত্তিতে নয়।'
তার ভাষায়, হয়তো অন্য দলগুলো নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রতি আগ্রহী ছিল, পুরো দলটির প্রতি নয়। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে জোট মানে দুটি দল সরাসরি একসঙ্গে আসা।
নির্বাচনের পর নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল বলে জানান এনসিপি নেতারা। তাদের দাবি, মাঠপর্যায়ে বিএনপি কর্মীদের হাতে এনসিপির কর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। জামায়াতের সঙ্গে জোট করলে আমাদের তৃণমূল কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
দলটির নেতারা বলেন, বিএনপি ধীরে ধীরে মধ্যপন্থী বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যাওয়ায় যে ভোটব্যাংক খালি হয়েছে, সেটি দখলের চেষ্টা করছে। এতে মধ্যপন্থী ডান রাজনীতির জায়গাটি ফাঁকা হয়ে পড়েছে।
এনসিপির একটি সূত্র জানায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে দলের ভরাডুবি ছিল আত্মসমালোচনার বড় মুহূর্ত।
সারোয়ার তুষার বলেন, এই ফল আমাদের জোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
পূর্ববর্তী জোট প্রসঙ্গে আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, আমাদের আগের গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট ছিল রাজনৈতিক জোট। কিন্তু জামায়াত ও অন্য আটটি দলের সঙ্গে যে জোট হচ্ছে, সেটি একটি নির্বাচনী জোট।
বর্তমানে জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটে এনসিপি ৩০টি আসন পাচ্ছে। তবে দলের ভেতরের আলোচনা অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৪০-এ উন্নীত করার চেষ্টা চলছে, যুদিও এনসিপি ৫১টি আসন চেয়েছিল।
এই সিদ্ধান্তে দলের ভেতরে একটি ছোট কিন্তু প্রভাবশালী অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যাদের মধ্যে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও আছেন।
ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, এনসিপিকে একটি 'বিগ জুলাই আমব্রেলা' আকারে স্বতন্ত্র উপায়ে দাঁড় করানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন—নূতন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াই, সামাজিক ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা, রিকনসিলিয়েশন, দায়-দরদের সমাজ গঠনের নীতিগুলো আদৌ গ্রহণ করা হয়েছে কি না।
জোট সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পাঁচজন নেতা পদত্যাগ বা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তারা হলেন—সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা, যুগ্ম সদস্যসচিব আরশাদুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শরমিন ও তাজনূভা জাবীন এবং যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক নাভিদ নওরোজ শাহ।
জারা পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। তাজনূভা দল ছাড়েন এবং নির্বাচন থেকেও সরে দাঁড়ান। মনিরা দলে থাকলেও নির্বাচন থেকে সরে যান।
এই অংশের নেতাদের মতে, জামায়াতের সঙ্গে জোট এনসিপির জন্য দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হবে।
পদত্যাগের ঘোষণায় তাজনূভা জাবীন লেখেন, 'আপনারা অনেকে ভাবছেন, হয়তো জামায়াতের সাথে জোটে ঐতিহাসিক কারণ বা নারী বিষয়ের কারণে আমার আপত্তি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর যে কারণ, সেটা হল যে প্রক্রিয়ায় এটা হয়েছে। এটাকে রাজনৈতিক কৌশল, নির্বাচনী জোট ইত্যাদি লেভেল দেয়া হচ্ছে। আমি বলব এটা পরিকল্পিত। এটাকে সাজিয়ে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে।'
তিনি অভিযোগ করেন, বিকল্প পথগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং নেতাদের কৌশলে এই প্ল্যাটফর্মে এনে কার্যত 'জিম্মি' করে রাখা হয়েছে।
মনোনয়ন প্রক্রিয়াও সমালোচনার মুখে আনেন তিনি। তার ভাষায়, মাত্র কিছুদিন আগে সমারোহে সারাদেশ থেকে মনোনয়ন সংগ্রহের ডাক দিয়ে ১২৫ জনকে মনোনয়ন দিয়ে ৩০ জনের জন্য সিট সমঝোতা করে বাকিদের নির্বাচন করতে দেয়া হবে না।
এখন আবার নেতাদের বলা হচ্ছে জামায়াত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাতে—যা আগে কখনো আলোচনায় আসেনি বলেও দাবি করেন তিনি।
মনিরা শারমিন তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, আমি এনসিপির স্বতন্ত্র শক্তিতে বিশ্বাসী। দলের প্রতি আমার কমিটমেন্ট আমি ভাঙি নাই। কিন্তু এই মুহূর্তে দলের প্রতি কমিটমেন্টের চেয়ে আমার গণঅভ্যুত্থানের প্রতি কমিটমেন্ট ও দেশের মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাভিদ নওরোজ শাহ লেখেন, তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও এনসিপিতে থেকে জুলাই সনদের পক্ষে 'হ্যাঁ' ভোটের প্রচার চালিয়ে যাবেন।
এদিকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন তার ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন, জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শের দলের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার মূল্য এনসিপিকে চড়া দামে দিতে হবে।
তার মতে, ন্যায়বিচার, সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র গঠনের প্রশ্নে ঐকমত্য ছাড়া কোনো রাজনৈতিক জোট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।