Image description
 

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এবিষয়ে ‘নোট ভার্বাল’ বা কূটনৈতিক পত্র পাঠানো হয়েছে বলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন।

দণ্ডিত হওয়ার আগেও হাসিনা ও একই মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেকে ফেরত চেয়ে একাধিকবার অনুরোধ জানালেও ভারত সাড়া দেয়নি। কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা যা বলছেন, তাতে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে এমন কোনো জোরালো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না।

এমন প্রেক্ষাপটে রায়ের পর দুই দণ্ডিতকে ফেরত চেয়ে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করা হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সেই সঙ্গে তাঁদের প্রত্যর্পণের বিষয়ে নেদারল্যান্ডসের হেগের স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) কাছে ‘অ্যাপ্রোচ’ করা যায় কিনা তাও পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত জানান।

সরকার ইতোমধ্যেই দিল্লির কাছে প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠিয়েছে। এখন আইসিসির কাছ থেকে সহায়তার পথ হয়তো খুঁজছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের সুযোগ হেগের আদালত কতটুকু আছে। বড় আয়না দেখলে, আইসিসির সদস্য হওয়ায় এর দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের আছে। কিন্তু ভারত সদস্য না হওয়ায় এই আদালতের আসলে কতটু কী করার আছে?

জোরালো রাজনৈতিক বার্তা, কিন্তু আইনি পথ অস্পস্ট

রায়ের পর সম্প্রতি সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের প্রত্যর্পণের জন্য আমরা ভারতের কাছে চিঠি দিচ্ছি। তাঁরা কনভিক্টেড (দোষী সাব্যস্ত), তাই ভারতকে আমাদের এক্সট্রাডিশন চুক্তি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কোনো ধরনের এপ্রোচ করা যায় কি না—আমরা বিবেচনা করব।’

সরকারের এই বক্তব্যে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির ইঙ্গিত রয়েছে, কিন্তু আইনগত দিক থেকে হিসাবটা এত সরল নয়। কারণ, দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায় বাংলাদেশ ভারতের কাছে অভিযুক্ত বা দণ্ডিতের প্রত্যর্পণ চাওয়ার অধিকার রাখে। তবে সব সেক্ষেত্রে ভারত ফেরত দিতে বাধ্য নয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে চুক্তিতে দুই পক্ষের তা এড়ানোর সুযোগ আছে। অন্য দিকে ভারতের প্রত্যর্পণ আইনও কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ না করা অধিকার দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো— প্রাণ হারানো ঝুঁকি থাকলে বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ মামলা হলে অভিযুক্ত বা দণ্ডিতকে ভারত ফেরত নাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষত আইসিসিতে যাওয়ার আলোচনা প্রাসঙ্গিক।

 

বাংলাদেশ সদস্য, ভারত নয়—তার অর্থ কী?

বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিউট বা রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর ও সংসদে অনুমোদন করায় নীতিগতভাবে দেশের ভেতরে সংঘটিত রোম সংবিধি সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে অথবা বাংলাদেশ সরকার স্বেচ্ছায় রেফার করলে আইসিসি তাত্ত্বিকভাবে এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে।

কিন্তু ভারত আইসিসির সদস্য নয়। দেশটি ভারত রোম স্ট্যাটিউটে স্বাক্ষর করলেও সংসদে তা অনুমোদন করেনি। ফলে, আইসিসির কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মানতে ভারত বাধ্য নয়। ভারতের মাটিতে কোনো অভিযুক্তকে আটক বা ফেরত পাঠাতেও আইসিসি তাকে চাপ দিতে পারে না।

আইসিসির সঙ্গে ভারতের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সদস্য হলেও ভারতের সদস্য না হওয়া পুরো প্রক্রিয়াকে বাস্তবে অসম্ভব করে তোলে।

আইসিসির হস্তক্ষেপে সুযোগ কোথায়?

তত্ত্বগতভাবে আইসিসি নিম্নলিখিত তিনটি পথে কোনো মামলায় জড়াতে পারে।

১. সদস্য রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় রেফার করলে—

অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী মামলাটি আইসিসিতে পাঠাতে পারত। কিন্তু তা না করে সরকার নিজস্ব আদালকে বিচার করেছে এবং রায়ে সন্তোষ জানিয়েছে। এখন এই মামলা আইসিসিতে রেফার করা আইনি দিক থেকে সংগত নয়।

 

২. আইসিসির প্রসিকিউটর নিজে তদন্ত শুরু করলে—

হেগের আদালতের প্রসিকিউটর যদি হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের নিজস্ব তদন্ত শুরু করেন এবং সেটার প্রমাণ মিললে হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়—অপরাধ কতটা গুরুতর, এখতিয়ার, প্রমাণ, সম্পূরকতা— বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু অভিযুক্ত যদি সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রের (ভারত) ভেতরে থাকেন, তাহলে সেটাও অসম্ভব।

৩. জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেফারেল হলেও আইসিসির হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে। নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে এমন কোনো অপরাধের বিষয়ে আইসিসিকে দায়িত্ব দিতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় চীন, রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র যে তাতে ভেটো দেবে না— এমনটা ভাবা অবাস্তব।

এই মামলায় আইসিসির কোনোভাবেই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই বলে মনে করেন যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক ও গবেষক ডেভিড বার্গম্যান। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও একটা বিষয় একেবারে স্পষ্ট— হাসিনার মামলায় এই আদালত কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না।

ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ চাইলে এই মামলাটি শুরুতেই আইসিসিতে রেফার করতে পারত, কিন্তু তারা তা করেনি। এখন যেহেতু বিচার শেষ হয়ে গেছে, তাই বিষয়টি কার্যত বন্ধ।’

বার্গম্যানের মতে, সরকার যদি নির্ভুল ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিচারপ্রক্রিয়া চাইত, তাহলে মামলাটিকে তারা আইসিসির কাছে পাঠাতো বা দেশের ট্রাইব্যুনাল সংস্কার করত। তারা কোনোটাই করেনি। সুতরাং আইসিসির পথ বন্ধ।

আইসিসি যেভাবে কাজ করে: ১০টি মৌলিক ধাপ

১) ১৮ বছরের নিচে অপরাধ হলে আইসিসি বিচার করে না

২) তদন্তের আগে ‘প্রাথমিক পরীক্ষা’ বাধ্যতামূলক

৩) প্রসিকিউটরকে দায়–অদায়— দুই দিকের প্রমাণই সংগ্রহ করতে হয়

৪) অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ

৫) অভিযুক্ত নিজের বোধগম্য ভাষায় তথ্য জানার অধিকার রাখে

৬) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন বিচারপূর্ব চেম্বার আদালত।

৭) অভিযোগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ‘সন্দেহভাজন’, পরে ‘অভিযুক্ত’

৮) বিচারের পর্যায়ে তিন পক্ষকে শোনা হয়— প্রসিকিউশন, আসামিপক্ষ, ভুক্তভোগী প্রতিনিধি

৯) রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষই আপিল করতে পারে

১০) মামলা খারিজ হলেও নতুন প্রমাণ পেলে আবার উন্মুক্ত করা যায়

এইসব ধাপ প্রয়োগের পূর্ব শর্তই হলো এখতিয়ার। কিন্তু ভারত সদস্য না হওয়ায় এখতিয়ার প্রয়োগই সম্ভব নয়।

প্রত্যর্পণ চুক্তিই একমাত্র উপায়

সুতরাং শেখ হাসিনা ও কামালকে ফেরাতে আপাতত সম্ভাব্য একমাত্র পথ দ্বিপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তি। এটাই একমাত্র কার্যকর আইনি পথ। তবে ভারত সেটা চায় কি না—এটাই মূল প্রশ্ন।

মিত্র শক্তিকে বাঁচাতে ভারত চাইলে মৃত্যুর ঝুঁকি দেখিয়ে প্রত্যর্পণের অনুরোধ সহজেই প্রত্যাখ্যান করতে পারে— পশ্চিমে বহু নজির আছে। সে হিসেবে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে আজীবন কারাবাস বা অন্য কোনো দণ্ড হলে হয়ত আন্তর্জাতিকভাবে চাপ তৈরির সুযোগ থাকত।

অতএব, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে হেগের আদালতের ভূমিকা শূন্যের কাছাকাছি। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক ও ভারতের সদিচ্ছার ওপর।