অনেক টানাপোড়েন, রাতভর দর-কষাকষি এবং অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে কপ৩০। শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন অংশগ্রহণকারীরা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কপ৩০ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ, গভীর হতাশা নিয়ে সম্মেলন শেষ করেছে।
ব্রাজিলের বেলেমে ১৩ দিন ধরে আলোচনা চললেও শেষ পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ে। এরপর অতিরিক্ত ১২ ঘণ্টা আলোচনা চালিয়ে গতকাল শনিবার (২২ নভেম্বর) সকালে একটি চুক্তির ঘোষণা আসে।
চুক্তিতে ১৯৪টি দেশ সম্মত হলেও তা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক কোনো বিধান নেই। যেকোনো দেশ পরবর্তীতে চাইলে চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াতে পারবে।
জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, এ ধরনের নমনীয় কাঠামো অনেকের কাছে হতাশাজনক। কারণ জলবায়ু সংকটের এই সময়ে শক্তিশালী বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও এবার মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠায়নি। ফলে শুরু থেকেই এই সম্মেলনের প্রভাব প্রশ্নের মুখে পড়ে।
এবারের চুক্তি অনেককে হতাশ করেছে উল্লেখ করে জাতিসংঘের জলবায়ু সেক্রেটারিয়েটের (ইউএনএফসিসিসি) নির্বাহী সেক্রেটারি সাইমন স্টিয়েল বলেন, ‘দায় স্বীকারে অস্বীকৃতি এবং নানা বিষয়ে বিভক্ত একটি বছরে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা শেষ পর্যন্ত একমত হতে পেরেছেন, এটাই প্রশংসনীয়।’
সাইমন স্টিয়েল আরও বলেন, ‘আমি বলছি না আমরা জলবায়ু লড়াইয়ে জিতছি। তবে আমরা এখনো নিঃসন্দেহে সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছি। আমরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছি।’
জীবাশ্ম জ্বালানিতে নীরবতা
কপ৩০–এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো চাইছিল একটি স্পষ্ট ও সময়বদ্ধ রোডম্যাপ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
কিন্তু তেল-উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের পুরোনো অবস্থানেই অনড় ছিল। তাদের মতে, অর্থনৈতিক বিকাশ ধরে রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। অথচ একই সময় জাতিসংঘ সতর্ক করে জানিয়েছে, প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য এখন ভীষণভাবে ঝুঁকির মুখে।
জলবায়ু সম্মেলনের ভেন্যুর বাইরে নিরাপত্তা কর্মীরা। ছবি: ইউএনবি
সৌদি আরব, রাশিয়া ও অন্যান্য উৎপাদক দেশ আলোচনার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেয়। তারা কোনো অবস্থাতেই জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দেওয়ার মতো শব্দচয়ন মানতে চায়নি। এতে আলোচনা ঠেকে যায়।
মূল আলোচনা সব দেশের সামনে হয়নি বলে শেষ মুহূর্তে অভিযোগ তোলে কলম্বিয়া, পানামা ও উরুগুয়ে। চূড়ান্ত চুক্তিতে শুধু বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানো নিয়ে আলোচনা চলবে। কিন্তু কীভাবে, কখন এবং কোন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী—কিছুই নির্ধারিত হয়নি।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি বিষয়টি এভাবে এড়িয়ে গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর কোনো বাস্তব পথই খোলা থাকে না।
বন নিধন নিয়ে আলাপ নেই
সম্মেলনটি আয়োজন করা হয় আমাজন বনের প্রবেশমুখে। তাই বন রক্ষায় শক্তিশালী ঘোষণা আসবে—এই প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু চুক্তিতে বন নিধন বন্ধ, সংরক্ষণ বা আমাজন রক্ষায় কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। পরিবেশবিদেরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত আয়োজক দেশ ব্রাজিলের জন্যও বিব্রতকর।
ব্রাজিল যতই বন রক্ষায় উদ্যোগী হোক, বৈশ্বিক সমর্থন ছাড়া আমাজন রক্ষা অসম্ভব। তাই এই নীরবতা জলবায়ু আন্দোলনের জন্য বড় ধাক্কা।
অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি
চুক্তিতে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা তিনগুণ বাড়াতে হবে। ধনী দেশগুলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ানের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলো বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলার পেতে পারে। কিন্তু এই অর্থ নতুন নয়। গত বছর ধনী দেশগুলো যে ৩০ হাজার কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই পুল থেকেই এই বরাদ্দ ধরা হচ্ছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, চুক্তিটি একটি অগ্রগতি, তবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সামনে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কারণ অতীতের প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি।
সব মিলিয়ে অর্থায়ন নিয়ে যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। অনেকে মনে করেন, চুক্তিটি নতুন তহবিল তৈরি করার সুযোগ হারিয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত দেশের হতাশা
লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড কীভাবে পরিচালিত হবে, কে কত দেবে এবং কোন দেশ কত পাবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই। ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো দ্রুত তহবিল চালুর দাবি তুলেছিল, কিন্তু এই দাবি শেষ পর্যন্ত আলোচনার জায়গা পায়নি।
জলবায়ু অভিযোজনের ব্যয় দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু বৈশ্বিক সহায়তা সেই গতি ধরে রাখতে পারছে না। তাই ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো উদ্বিগ্ন।
গত এক দশকে জলবায়ু–সম্পর্কিত দুর্যোগে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাংলাদেশ সেই তালিকায় অন্যতম। কিন্তু কপ৩০–এ এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যা সরাসরি এসব দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। উপকূলীয় এলাকা, কৃষি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা—সব জায়গায় জলবায়ুর প্রভাব বাড়ছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ভবিষ্যতে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের উপকূল, শহর ও কৃষিজমিতে।
অন্যদিকে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা নেই। আগের প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক সময় বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে কপ৩০ বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি স্বস্তি আনতে পারেনি।
জলবায়ু সম্মেলনে ইন্দোনেশিয়া প্যাভিলিয়নের বাইরে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: ইউএনবি
১.৫ ডিগ্রির সংকট
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো ছাড়া পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু কপ৩০–এ সেই সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আশঙ্কা আরও বেড়েছে। এখন পৃথিবী এগোচ্ছে ৩ ডিগ্রি উষ্ণতার দিকে। এই পরিস্থিতি নিম্নভূমি বাংলাদেশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলবে।
এই সতর্কতা নতুন নয়। তবে কপ৩০ নতুন করে বুঝিয়ে দিল, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এখনো তৈরি হয়নি।
জলবায়ু রাজনীতির টানাপোড়েন
এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। চীন কৌশলগতভাবে নীরব থেকেছে। ভারত ছিল কঠোর অবস্থানে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছিল অভ্যন্তরীণ চাপে।
এই জটিলতা আলোচনার গতি কমিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ এবং গ্রান্টভিত্তিক অর্থায়নের দাবি তুললেও বড় শক্তিগুলো সে দাবি পুরোপুরি মানেনি।
সব মিলিয়ে কপ৩০ শেষ হয়েছে একটি আপসের চুক্তিতে। যা প্রতিশ্রুতির সংখ্যা বাড়িয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয়নি।
এবারের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ছিল না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুষ্ঠান এড়িয়ে গেছেন। কপ-৩০ প্রধান ব্রাজিলীয় কূটনীতিক আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো হতাশ হয়ে বলেন, যারা মনে করে যে সহযোগিতা জলবায়ু সমস্যার সমাধান নয়, তারা আনন্দিত হবে এই দেখে যে আমরা নিজেদের মধ্যে কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারছি না।