Image description
 

বগুড়ার সাতটি সংসদীয় আসনে নির্বাচনি প্রচারণা জমে উঠেছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান প্রার্থী হওয়ায় নেতাকর্মীরা বিভেদ ভুলে ধানের শীষের জন্য রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন।

 

জামায়াত প্রার্থীরা বসে নেই, তারাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বিএনপি সব আসনে শতভাগ জয়লাভের আশা করলেও জামায়াত চারটিতে বিজয়ী হওয়ার আশা করছে।

বিএনপি প্রার্থী ও দলীয় নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের পক্ষে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা প্রদান ও অন্যান্যভাবে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। জামায়াতও একই পন্থা অবলম্বন করছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বগুড়ায় হাজারও নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে মামলা দেওয়া হয়েছে।

অনেকে গ্রেফতার হয়ে জেলে আবার অনেকে বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারো কারো বাড়িঘর ও কর্মস্থলে আগুন দেওয়া, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদী কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন বলে প্রচারণা রয়েছে।

এসব কারণে সাধারণ জনগণ ও আওয়ামী ঘরানার ভোটাররা বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। জামায়াত থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা-হামলা না করায় তারা ওই সব ভোটারদের সুনজরে আছেন। এ বিপুলসংখ্যক ভোট জামায়াতের পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তারা বগুড়ার সাতটি আসনের মধ্যে চারটিতে প্রচণ্ড আশাবাদী।

নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতাকর্মী জানান, বগুড়া জেলায় তাদের সংগঠনের কে সন্ত্রাসী, কে অপরাধী, কে অবৈধ আয়, কে প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে- তা সবাই জানে। এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা বা তাদের প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে শাস্তি দিলেও তারা কষ্ট পেতেন না। কিন্তু গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গণহারে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের হাজারও নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে মামলা দেওয়া হয়েছে। মব সৃষ্টি করে অনেককে নির্যাতনের পর পুলিশে দেওয়া হয়েছে।

ভিন্নমতাবলম্বীদের অধিকাংশ বাড়িঘর পুরুষশূন্য। তারা মামলা ও হামলার ভয়ে পালিয়ে রয়েছে। আদালত থেকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিলেও নিম্ন আদালত জেলে পাঠাচ্ছে। আত্মসমর্পণ বা গ্রেফতারের পর আদালতে নেওয়া হলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মব সৃষ্টি করে মারপিট ও শরীরে পচা ডিম মারা হচ্ছে। তাই অধিকাংশ আসামি নেতাকর্মীরা জামিন না নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে রয়েছেন। ফলে অনেক পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ওই সংগঠনটির কয়েকজন নেতাকর্মী দাবি করেন, বগুড়ার সাতটি আসনে তাদের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ভোট আছে। এখন ভোট আরও বাড়ছে। তাই তাদের ভোট যেদিকে পড়বে তারাই নির্বাচিত হবেন। জামায়াত থেকে কোনো মামলা বা হয়রানি না করায় তাদের ভোট জামায়াতের পক্ষে পড়তে পারে। ফলে সংগঠনটি এবার বগুড়ার সাতটি আসনের মধ্যে বিএনপির কাছে ২-৩টি ভোটের মাধ্যমে ছিনিয়ে নিতে পারে। তাই তারা ভোটের স্বার্থে বিএনপির এ নির্যাতন-জুলুম বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

বগুড়া জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবদুল হক সরকার ও শহর শাখার সেক্রেটারি আসম আবদুল মালেক বলেন, আমিরে জামায়াতের নির্দেশে তারা প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের ওপর অত্যাচার জুলুম করেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাদের নির্দেশে যে পুলিশ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন করেছেন। তাদের আমরা চিনলেও প্রতিশোধ নিতে মামলা করা হয়নি। এমনকি নির্যাতনকারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও একটা মামলা করেননি। এসব কারণে প্রতিটি আসনে জামায়াতের ভোট প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে। এছাড়া নির্যাতিত অন্য দল (আওয়ামী লীগ) তাদের ভোটগুলো জামায়াতকে দেবে। এসব কারণে তারা (জামায়াত) বগুড়ার সাতটি আসনে জয়লাভের আশা করেন। তবে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ), বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া), বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী।

এ প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মোশারফ হোসেন জানান, বগুড়া শহীদ জিয়া, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ঘাঁটি। নিরপেক্ষ নির্বাচনে তারা বগুড়ার কোনো আসনে কখনো পরাজিত হননি। এবার বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বগুড়ার দুটি আসন থেকে প্রার্থী হচ্ছেন। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হবেন। এটা বগুড়াবাসীর জন্য বড় পাওয়া হবে।

বগুড়া-২ আসনে এখনও বিএনপির প্রার্থী না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি (মোশারফ) জানান, দলের প্রধান নীতিনির্ধারক তারেক রহমান যেকোনো সময় প্রার্থী পরিবর্তন করতে পারেন। সেখানে আসনটি বিএনপির মীর শাহে আলমকে না দিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে দিলেও কোনো সমস্যা নেই। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে নির্বাচিত করা হবে। তাই তিনি আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়ার সাতটি আসনে বিপুল ভোটে বিজয় হবেন বলে শতভাগ আশা করেন।

অন্যদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি এনসিপি, নাগরিক ঐক্য, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাসদ ও অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছেন। তারা সব ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছেন। জোট বেঁধে নেতাকর্মীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন।

বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি কাজী রফিকুল ইসলাম, জামায়াতের সাবেক জেলা আমির অধ্যক্ষ শাহবুদ্দিন, ইসলামী আন্দোলনের এবিএম মোস্তফা কামাল পাশা প্রমুখ মাঠে রয়েছেন।

বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলমকে সবুজ সংকেত দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে প্রার্থী করা হয়নি। শোনা যাচ্ছে জোটের স্বার্থে এ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে প্রার্থী করা হতে পারে। যদিও তিনি চারবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও একবারও বিজয়ী হতে পারেননি।

এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী সাবেক এমপি মাওলানা শাহাদাতুজ্জামান। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মুফতি জামাল পাশা ও বাসদের মাসুদ পারভেজও মাঠে রয়েছেন।

বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া-আদমদীঘি) আসনে বিএনপির প্রার্থী আদমদীঘি উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল মুহিত তালুকদার। তিনি দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে মাঠে রয়েছেন। জামায়াত থেকে প্রার্থী করা হয়েছে নূর মোহাম্মদ আবু তাহেরকে। ইসলামী আন্দোলনের শাজাহান তালুকদার ও বাসদের সুরেশ চন্দ্র দাস দলীয় প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন।

বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি মোশারফ হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার দুই উপজেলায় কাজ করে যাচ্ছেন। সুখে-দুঃখে সবার পাশে রয়েছেন। এখানে জামায়াতের প্রার্থী ঢাকা মহানগর শিবিরের সাবেক সভাপতি মোস্তফা ফয়সাল পারভেজ। বাসদের সাইফুজ্জামান টুটুল, ইসলামী আন্দোলনের ইদ্রিস আলী প্রার্থী হয়েছেন।

বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। এখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের দবিবুর রহমান, বাসদের সন্তোষ সিং, ইসলামী আন্দোলনের মীর মাহমুদুর রহমান।

বগুড়া-৬ আসন (সদর) আসনে ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এবার তার স্থলে ছেলে তারেক রহমানকে প্রার্থী করা হয়েছে। ‘ভিভিআইপি’ এ আসনে তারেক রহমানকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করতে নেতাকর্মীরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এখানে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন- বগুড়া শহর জামায়াতের আমির আবিদুর রহমান সোহেল। সোহেল ফুটবল টুর্নামেন্টসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন।

এছাড়া এ আসনে বাসদ থেকে অ্যাডভোকেট দিলরুবা নূরী ও ইসলামী আন্দোলনের আনম মামুনুর রশিদ প্রমুখ প্রার্থী হয়েছেন।

জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনটিও ‘ভিভিআইপি’। এবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের অধিকাংশ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। যদিও তিনি এসব আসনে কখনো সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেননি। খালেদা জিয়া প্রার্থী হওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে আনন্দের জোয়ার বইছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা এলাকার পুত্রবধূর জন্য দোয়া ও ভোট চাইছেন।

এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী কেন্দ্রীয় শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী প্রার্থী হয়েছেন। তিনি মোটরসাইকেল শোডাউনসহ বিভিন্নভাবে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এ আসনে বাসদের শহিদুল ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের শফিকুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন।

সাধারণ ভোটাররা বলছেন, বগুড়ার সাতটি আসনে এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়নি। প্রার্থী যতই হোক মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীর মধ্যে। তবে বিএনপি মামলা, হামলা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এ কারণে সব আসনে জামায়াতের ভোট বাড়ছে। এছাড়া আসনগুলোতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভোটগুলো ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ আসনে এসব ভোট যাদের বাক্সে পড়বে তারা নিশ্চিত বিজয়ী হবেন।

তারা আরও বলেন, যে দল বা প্রার্থী প্রতিহিংসা ছেড়ে উন্নয়নের রাজনীতি করবেন, তাদের জনগণ ভোট দেবেন।