২০২৫-এর সেপ্টেম্বরে হাজার হাজার তরুণ বিক্ষোভকারী কাঠমান্ডুর রাজপথে নেমেছিল। তারা নেপালের পার্লামেন্টে তুলকালাম করেছিল। চরম দুর্নীতির কারণে তারা ছিল ক্ষুব্ধ। বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত দমনে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা। কর্তৃপক্ষ বহু বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলিকে পদত্যাগে বাধ্য করে। অন্তর্বর্তী একটি সরকার দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় যে ধারা চলে আসছে, নেপাল ছিল তার সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। ২০২৪-এ তরুণদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের ইতি ঘটায়। শ্রীলঙ্কাতেও বারবার গণবিক্ষোভ হয়েছে। সবচেয়ে বড়টা হয়েছে ২০২২ সালে। দুর্নীতিগ্রস্ত একটা সরকারকে তারা হটিয়ে দিয়েছে। মালদ্বীপেও দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ, গণতন্ত্রের অবনতি এবং বিদেশি সম্পর্কের কারণে বিক্ষোভ উসকে উঠেছিল। সেখানেও মানুষ পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল।
এসব পরিবর্তন এসেছে স্থানীয় সমস্যা থেকে। কিন্তু এটি পুরো গল্প নয়। বহু বছর ভারত নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র দাবি করে এসেছে। উদার মূল্যবোধের কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে গণতন্ত্রের কেন্দ্র মনে করেছে। কিন্তু ভারত নিজের অঞ্চলে কাজ করেছে অত্যন্ত অনুদার নীতিতে। স্বৈরশাসকদের তারা সমর্থন দিয়েছে। অন্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। নয়াদিল্লি নিজের স্বার্থের জায়গায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেনি।
যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে ঘাঁটাতে চায়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতকে তারা কখনোই প্রশ্ন করেনি। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ ইস্যুই ভারতের হাতে ছেড়ে দেয়। তারপরও প্রতিটি মার্কিন সরকারই একই কাজ করেছে। নয়াদিল্লি প্রতিবেশী সরকারগুলো অর্থ, পশ্চিমা লবি বা নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে সাহায্য করেছে। বিনিময়ে তাদের ভুলগুলো নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে ওয়াশিংটন। এমনকি ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে, এমন ইস্যুতে গণতন্ত্র নিয়েও তারা কিছু বলেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো ভারতকে আঞ্চলিক মাস্তান মনে করে। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র এটা মেনে নিয়েছে। সে কারণে ভারতের প্রতি ক্ষোভ আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস জন্মেছে তাদের মধ্যে। সেখান থেকে সহিংস সরকার পতনের আন্দোলনগুলো হয়েছে। নেপালের সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানে বিক্ষোভকারীরা ভারতের টিভি ক্রুদের ওপরও হামলা করেছিল। এদের তারা সংকটের অংশ মনে করে। এই ক্ষোভ ভারতের ক্ষতি করেছে। আবার চীনের প্রভাব বাড়াতেও সেটা সাহায্য করেছে। নয়াদিল্লির অনুগত সরকারগুলো প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বেইজিং সক্রিয় হয়েছে। তারা নতুন নেতাদের কাছে ঋণ আর অস্ত্র সহায়তা নিয়ে এসেছে। সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার চীনমুখিতা ওয়াশিংটনের জন্য ক্ষতিকর। সরকারগুলো বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতা আর আস্থা হারাচ্ছে। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইন্দো-মার্কিন সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। ওয়াশিংটনের ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল দরকার। ছোট দেশগুলোকে তাদের সত্যিকারের অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে, ভারতের বর্ধিতাংশ হিসেবে নয়।
ভারত আউট
ভারতের যে গণতন্ত্রের দাবি আর স্বৈরাচারের প্রতি সমর্থন, সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। এক দশকের বেশি ভারত হাসিনা আর তার আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে গেছে। হাসিনার শাসন চরম স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। নয়াদিল্লির সাহায্য নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করে ফেলেছিলেন হাসিনা। বিচার বিভাগ আর নির্বাচন কমিশন ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো কঠোর আইন ব্যবহার করেছেন তিনি। অনলাইন বাকস্বাধীনতা দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। বিরোধীদের বাছ-বিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার করেছে তার সরকার।
হাসিনার সরকার ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করেছে। বাংলাদেশের ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশের দমনমূলক শক্তিকে আরো শক্তি জুগিয়েছে ভারত। নয়াদিল্লি র্যাবকে সুরক্ষা দিয়েছে। এই বাহিনী রাজনীতিবিদ, অ্যাকটিভিস্ট এবং সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছে। ২০২৩ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনার আমলে বহু মিলিয়ন মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গ্রেপ্তার, অন্যায় মামলা ও সহিংসতার শিকার হয়েছে তারা। ভারতের নেতারা হাসিনার কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়েছেন। তারা হাসিনাকে স্থিতিশীলতার পক্ষে ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দমনপীড়ন নিয়ে তারা টুঁ শব্দটি করেননি।
ভারতের প্রতি এ কারণে বাংলাদেশের জনমানুষের ক্ষোভ বেড়েছে। ২০২৪-এর শুরুর দিকে ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলন শুরু হয়। ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। জনগণ ভারতের পণ্য বয়কট শুরু করে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণা শক্তি পেতে থাকে। সরকার ২০২৪-এর মাঝামাঝি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করে। জাতিসংঘ জানায়, এই আন্দোলনে ১৪০০ নিহত হয়েছে। এতে ক্ষোভ আরো ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। সামরিক বাহিনী হাসিনাকে পরিত্যাগ করে। তার সরকারের পতন হয়। তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ফলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়। এখন তারা নয়াদিল্লির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে।
হাসিনার পতনের আগে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি। ভারতের কথামতো চলেছে তারা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সমস্যা দেখেছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা। কিন্তু শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেননি। ভারতের মতো তারাও হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। বাইডেন একটু সাহসী হয়েছিলেন। র্যাবের ওপর ২০১১-তে নিষেধাজ্ঞা দেন তিনি। ২০২৩ সালে নির্বাচন কারচুপিতে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু বড় কোনো শাস্তি দেননি তারা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্টের ভয় ছিল তাদের। তারা বলেছিলেন, ২০২৪-এর নির্বাচন অবাধ হয়নি, সুষ্ঠুও হয়নি। কিন্তু আর কিছুই তারা বলেননি।
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কথাগুলোকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ না দেখে তারা হতাশ হয়েছে। হাসিনার পতনের পর চীন দ্রুত সক্রিয় হয়েছে। ২০২৪-এর অক্টোবরে চীনা যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রাম এসেছিল। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটা ছিল কোনো বিদেশি নৌবাহিনীর প্রথম বাংলাদেশে আগমন। পরে আরো সফর হয়েছে। চীন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি দিয়েছে। প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। ২০২৫-এর মাঝামাঝি নাগাদ প্রতিরক্ষা ও মুক্তবাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জুনে বাংলাদেশ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্মেলনে যোগ দেয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। হাসিনার ভারতমুখিতা থেকে বের হয়ে চীনমুখী হয় বাংলাদেশ। নতুন সরকার চীন আর পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য গড়তে চেয়েছে। তারা প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়েছে। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তার দ্বৈবভাবে হয়নি। ভারতের প্রতি মার্কিন উদাসীনতার কারণে হয়েছে। ভারতের স্বৈরাচার-পোষকতাকে চ্যালেঞ্জ না করে ওয়াশিংটনই আসলে চীনের রাস্তা খুলে দিয়েছে।
অস্থির দ্বীপপুঞ্জ
মালদ্বীপেও একই ধরনের ঘটনা দেখা গেছে। ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ক্ষোভের কারণে সরকার বদলে গেছে। চীনের প্রভাব বেড়েছে। বোঝা গেছে, গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত করে স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা খুঁজতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। ওয়াশিংটন আর নয়াদিল্লির এখান থেকে শেখা উচিত।
২০১৩ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারত তাকে ঘনিষ্ঠ মিত্রজ্ঞান করেছিল। মালের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করেছিল। ইয়ামিন যতই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন, এর মাত্রা তত বেড়েছিল। ২০১৬ সাল নাগাদ নয়াদিল্লি প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করেছিল। ইয়ামিনকে ভারতে সাদর সম্ভাষণ জানানো হয়েছিল। ভারতকে মালদ্বীপের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার বানিয়ে চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে ফেলেছিলেন ইয়ামিন। সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের মতো বিরোধীদের তিনি কারাগারে ভরেছিলেন। বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। ২০১৫ ও ২০১৮ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তিনি। এতে বিরোধীদের দমন করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সুবিধা হয়েছিল তার। ২০১৬ সালে কমনওয়েলথ মালদ্বীপকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। নয়াদিল্লি সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করে। নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে কথাবার্তা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। মালদ্বীপকে কমনওয়েলথ থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে দিল্লি। মালদ্বীপের মানুষ এটাকে দমন-নিপীড়নের প্রতি ভারতের অনুমোদন হিসেবে দেখেছে।
২০১৮ সালে ভোটাররা ইয়ামিনকে ছুড়ে ফেলে। ইন্ডিয়া আউট প্রচারণা শুরু হয়। কৌতুকের বিষয় হলো ভারতপন্থি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহের কাছে হেরে যাওয়ার পর ইয়ামিন নিজেই এই প্রচারণার নেতৃত্ব দেন। ভারতকে নতুন সাম্রাজ্য আখ্যা দেন তিনি। ২০২২-এ ইয়ামিনের দলের ভারতবিরোধী বয়ান আরো জোরালো হয়। ভারতীয় সেনাদের মালদ্বীপ ছাড়ার দাবি তোলেন তারা। এতে ২০২৩-এ মোহাম্মদ মুয়িজ্জুর জয় সহজ হয়। তিনি ছিলেন ভারতবিরোধী বলয়ের অংশ। বিজয়কে তিনি সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের সঙ্গে তুলনা করেন। ভারতীয় সেনাদের তিনি দেশ থেকে বের করে দেন। প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করেন। দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সম্পর্ক স্থগিত করেন। নরেন্দ্র মোদি ২০২৫-এর জুলাইয়ে মালে সফরে যান। মুয়িজ্জু জেতার পর সেটা ছিল তার প্রথম সফর। বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেন তারা। ৫৬৫ মিলিয়ন ডলারের পুঁজি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। এর সূত্র ধরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুই দেশের। কিন্তু বিশ্বাসে এখনো ফাটল রয়ে গেছে। পুরোনো সম্পর্কের জায়গায় তারা এখনো ফেরেনি।
মালদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ সাগরপথের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইন্দো-প্রশান্ত পরিকল্পনার ক্ষুদ্র অংশ মনে করছে। ওয়াশিংটন এটাকে ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক অবনতির জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা তারা দেয়নি। ইয়ামিনকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চীন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। চীনের কাছে মালদ্বীপের বড় ঋণ পরিশোধ সহজ করেছে তারা। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে মুয়িজ্জু বেইজিং সফর করেছেন। তারা অবকাঠামো, বাণিজ্য, মৎস্যসম্পদ এবং ডিজিটাল সংযোগ নিয়ে চুক্তি করেছেন।
জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ২০২৪-এর জুনে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জামিরকে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানান। তিনি নিরাপত্তা ও নৌ-সহায়তার প্রস্তাব দেন। কিন্তু চীনের তুলনায় সেটা ছিল সামান্য। চীন তাদের সামরিক অনুদান, যন্ত্রাংশ, প্রশিক্ষণ এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তি দিয়েছিল। বড় প্রকল্প দিয়েছিল। মালদ্বীপের মানুষ পশ্চিমাদের অবহেলা টের পেয়েছে। মার্কিন পদক্ষেপকে তারা চীনা তৎপরতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র বা অধিকার প্রশ্নে সত্যিকারের সহায়তা হিসেবে দেখেনি। স্বচ্ছতা ও নাগরিক সমাজকে সমর্থন না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ক্ষমতার খেলার দিকে ঝুঁকেছে।
হিসাব-নিকাশ, দায়বদ্ধতা নয়
শ্রীলঙ্কাতেও ভারতীয় প্রভাবের প্রতি অনীহা আর চীনের প্রভাব বাড়তে দেখা গেছে। ২০০৯ সালের গৃহযুদ্ধের পর ভারত শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছিল। তামিল টাইগাররা যুদ্ধে হেরে যায়। কিন্তু এই সমর্থনের ক্ষেত্রে মানবাধিকার অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। ২০০৯-এর হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অধিবেশনে ভারত শ্রীলঙ্কার প্রশংসা করে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। পশ্চিমাদের দ্বারা যুদ্ধাপরাধের তদন্ত আটকে দেয় তারা।
বহির্বিশ্বের চাপ থেকে শ্রীলঙ্কাকে বারবার সুরক্ষা দিয়ে গেছে নয়াদিল্লি। প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে তারা সুরক্ষা দিয়েছে। তামিল ইস্যুকে উপেক্ষা করে তিনি ক্ষমতা নির্মাণ করেছিলেন। তামিলদের মানবাধিকার ইস্যুকে তিনি পশ্চিমের মিথ্যাচার আখ্যা দিয়েছিলেন। মোদি-রাজপাকসের বৈঠকে নিরাপত্তা প্রাধান্য পেয়েছে। অধিকারের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করেছে তারা। ভারতের নীতি বলে : নিরাপত্তার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলাও, তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা সংখ্যালঘু দমনের ইস্যু কোনো সমস্যা হবে না।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে জয়লাভ করে। তার অব্যবস্থাপনায় বিক্ষোভ উসকে ওঠে। নয়াদিল্লি তখন প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল। সেখানে কোনো শর্ত ছিল না। ভারত ছিল তাদের শেষ ঋণদাতা। কিন্তু তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামরিক শাসন বা দুর্নীতির সমস্যা সমাধানের জন্য কিছুই বলেনি। ভারতের সহায়তায় পতন বিলম্বিত হয়েছে মাত্র। ২০২২-এর জুলাইয়ে বিক্ষোভকারীরা রাজপ্রাসাদে হামলা করে। গোতাবায়া পালিয়ে যান। বহু শ্রীলঙ্কান ভারতকে অপশাসনের সমর্থক হিসেবে দেখেছে। প্রাসাদের দেয়ালে বিক্ষোভকারীরা ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান লেখেছিল। নতুন নেতা রানিল বিক্রমাসিঙ্গে তখন চীনের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। বেইজিং দুই বছরের জন্য ঋণ পরিশোধ বন্ধ রেখেছিল। তারা হাম্বানতোতাতে ৫ বিলিয়ন ডলারের শোধনাগার গড়তে সাহায্য করেছিল। এটা ছিল শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগগুলোর একটি। কাজ শুরু হলে এটা হবে ভারতের উপকূলের কাছে একটি চীনা হাব।
বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারতকে তারা অনুসরণ করে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ওয়াশিংটন জাতিসংঘের তদন্তকে সমর্থন দেয়। ২০২২-তে ভারত সহায়তা নিয়ে আসে। কিন্তু সুশাসন বা দুর্নীতিবিরোধী কোনো নিয়ম তারা আরোপ করেনি। মার্কিন নেতারা ভারতের ঋণের প্রশংসা করে। দায়বদ্ধতা নিয়ে তারা একটি কথাও বলেনি। তরুণ বিক্ষোভকারীরা দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতায় রাখার জন্য নয়াদিল্লি আর ওয়াশিংটনকে দোষারোপ করে।
নয়াদিল্লিকে প্রত্যাখ্যান
নেপালিরা দেখেছে ভারত বহু দশক ধরে গণতন্ত্রের চেয়ে নিজেদের প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়েছে। এতে অভ্যুত্থান খারাপতর হয়েছে। ১৭ বছরে সেখানে ১৪ বার সরকার বদল হয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে পরিবর্তনের মধ্যেই নেপালের সমস্যাগুলো জমে আছে। কিন্তু বহু নেপালি মনে করেন, ভারতের হস্তক্ষেপ এ সমস্যাকে আরো জটিল করেছে।
২০১৫-এর শেষে এবং ২০১৬-এর শুরুতে নয়াদিল্লি নেপালের ওপর অবরোধ দিয়েছিল। সংবিধান পরিবর্তনের কারণে তাদের শাস্তি দিয়েছিল দিল্লি। এই অবরোধ পরিবহন ও হাসপাতালের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ভূমিকম্পের পরে সেটা মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছিল। সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। ২০২০ সালে অনলাইনে #ব্যাকঅফইন্ডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু হয়। ভারতের দাদাগিরির কারণে নেপালিরা যে ক্ষুব্ধ, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ওই প্রচারণায়। ২০২৫-এ বিক্ষোভকারীরা দুর্নীতি এবং সেখানে ভারতের ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করে।
ওয়াশিংটন নেপালকে ভারতের প্রভাব বলয়ের অংশ মনে করে। তারাও ত্রাণ আর সহায়তা কমিয়ে দেয়। নয়াদিল্লিকে ক্ষুব্ধ করতে পারে, এমন কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা তারা চালায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সহায়তা ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ তহবিল। বিদ্যুৎ লাইন ও রাস্তাঘাটে অর্থায়ন করা হয় এর মাধ্যমে। বহু নেপালি এটাকে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণে ইন্দো-মার্কিন পরিকল্পনা হিসেবে দেখে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে বিরোধীরা পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভ করে। তারা মার্কিন ও ভারতীয় পতাকা পোড়ায়।
এই উত্তেজনা ও অস্থিরতা চীনকে সুবিধা দিয়েছে। ২০১৭ সালে নেপাল চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মসূচিতে যুক্ত হয়। কাঠমান্ডু-কেরুং রেল, ডাইলেখ তেল অনুসন্ধান এবং হিমালয়ান করিডোরের মতো প্রকল্প পেয়েছে তারা এর মাধ্যমে। চীনের বাণিজ্য দ্রুত বেড়েছে। বেইজিং কোনো শর্ত ছাড়া ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে। ক্ষমতা ছাড়ার আগে ২০২৪-এ বেইজিং সফর করেছিলেন ওলি। তিনি রেল ও নিরাপত্তা আলোচনা আবার শুরু করেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার এই চীনঘেঁষা নীতি বজায় রেখেছে। স্থানীয়ভাবে তারা জবাবদিহি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
ভালো বেড়া, ভালো প্রতিবেশী
দক্ষিণ এশিয়ার এই ধারাটা খুব স্পষ্ট। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর ভারত নিজেদের স্বার্থকে স্থান দেয়। সম্পর্ক শক্তিশালী রাখতে ওয়াশিংটন এগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। স্থানীয়রা এটাকে মার্কিন মদতের ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ মনে করে। তাদের ক্ষোভের কারণে চীনের সহায়তা আর প্রভাবের দরজা খুলে গেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। এগুলো পরস্পর সংযুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রগুলো বড় শক্তিগুলোর লড়াইয়ের ক্ষেত্র। ভারতের অন্যায় হস্তক্ষেপ আর দাদাগিরি চীনের পথ খুলে দিয়েছে। মার্কিন নীতি যতদিন ভারতকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাবে, ততদিন তারা এই অঞ্চলকে বেইজিংয়ের দিকে ঠেলতেই থাকবে।
ভারতের নীতি নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ সমস্যা মেটাতে পারবে না। অভিন্ন কার্যকর গণতন্ত্রের মাধ্যমে সেটা করতে হবে। দুটো বৃহত্তর গণতন্ত্রকে অবশ্যই মূল্যবোধের ভিত্তিতে কৌশল নিতে হবে। তা না হলে চীন তাদের পদস্খলনের সুবিধা নেবে।
দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার একটা সুযোগ এসেছে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। মার্কিন-ভারত সম্পর্ক ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ঝাঁকুনি খেয়েছে। রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে শুল্কের বোঝা আরোপিত হয়েছে ভারতের ওপর। এখন অংশীদারত্ব নিয়ে কাজ করার সময় কর্মকর্তাদের এই অঞ্চল নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। এটা ভারতের উঠান নয়। এখানে স্বাধীন দেশ রয়েছে, যেখানে বহু মিলিয়ন মানুষের বসবাস। স্থানীয়দের কথা শুনতে হবে। অধিকার ও উদারতার ব্যাপারে স্পষ্ট নিয়ম ঠিক করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে চায়, তাহলে ভারতের নেতিবাচক নীতির প্রতি উদাসীনতা তাদের ত্যাগ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। নাগরিকরা দমন বা অপশাসন মেনে নেবে না। বিশেষ করে, বিশ্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদারের কাছ থেকে তো নয়ই।
মুহিব রহমান
ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর