Image description

ঢাকার ২০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ফাঁকা রাখা ৭টি আসনে প্রার্থিতা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এসব আসনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জোট ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এ রকম দুটি দলের দুজন নেতাকে ঢাকায় আসন ছাড় দিচ্ছে বিএনপি।

আরেকটি আসনে ইসলামপন্থী একটি দলের শীর্ষ নেতার কথা ভাবা হচ্ছে। বাকি চারটি আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

৩ নভেম্বর ২৩৭টি সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে বিএনপি। অবশ্য এক দিন পরই মাদারীপুর-১ আসনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৩০০ (সংরক্ষিত নারী আসন বাদে)।

এখন পর্যন্ত ৬৩টি আসনে প্রার্থিতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি। এর মধ্যে ঢাকার ৭টি আসন রয়েছে। আসনগুলো হলো রাজধানীর লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর (আংশিক) ও কোতোয়ালি (আংশিক) এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৭ আসন; সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৯; ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, কলাবাগান ও হাজারীবাগ এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১০; মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর (আংশিক) নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩; ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও গুলশান-বনানী এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭; বৃহত্তর উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৮ এবং ধামরাই উপজেলা নিয়ে গঠিত ঢাকা-২০ আসন।

জোট ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এ রকম দুটি দলের দুজন নেতাকে ঢাকায় আসন ছাড় দিচ্ছে বিএনপি।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকা-৭ আসনটি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হককে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা আছে। তবে এখন পর্যন্ত মামুনুল হকের সম্মতি পাওয়া যায়নি। যদিও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দলের সঙ্গে পাঁচ দফা দাবির (অন্যতম দাবি হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা) আন্দোলনে রয়েছে। এরপরও মামুনুল হকের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা যোগাযোগ রাখছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা-১৭ আসনে বিএনপি ছাড় দিচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমানকে (পার্থ)। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। নিজের নির্বাচনী এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে প্রার্থিতা জানান দিয়েছেন আন্দালিভ রহমান।

একইভাবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকেও আসন (ঢাকা-১৩) ছাড় দিচ্ছে বিএনপি। তিনি ইতিমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে প্রচার শুরু করেছেন।

ঢাকা-১৭ আসনে বিএনপি ছাড় দিচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমানকে (পার্থ)। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। নিজের নির্বাচনী এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে প্রার্থিতা জানান দিয়েছেন আন্দালিভ রহমান।

এক পরিবার এক প্রার্থী ‘নীতি’

ঢাকা-৯ আসনেও প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। এই আসনে জোটের নাকি দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, সেটিও নিশ্চিত নয়। এ আসনে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস মনোনয়ন চান। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী। মির্জা আব্বাসকে ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

এবার এক পরিবার থেকে একজনকে প্রার্থী করার ‘নীতি’ নিয়েছে বিএনপি। এ কারণে আফরোজা আব্বাস বাদ পড়েছেন, দলে এমন আলোচনা আছে। যদি দু-একজনের ক্ষেত্রে এই নীতি শিথিল করা হয়, তাহলে আফরোজা আব্বাস মনোনয়ন পেতে পারেন। অথবা দলের অন্য কোনো নেতাকেও প্রার্থী করা হতে পারে।

এই আসনে নির্বাচন করতে চান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা। এনসিপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হলে তাঁকে বিএনপি সমর্থন দিতে পারে, এমন আলোচনাও আছে।

ঢাকা-১০ ও ২০ আসন

ঢাকা-১০ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম ও শেখ রবিউল আলম (রবি)। দুজনের মধ্যে অসীম বিএনপির চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সহায়ক কমিটির সদস্য, অন্যদিকে রবিউল বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য।

নাসির উদ্দিন অসীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আসনের ৪২ শতাংশ ভোটার আমাদের নোয়াখালী অঞ্চলের। আশা করি, মনোনয়নের ক্ষেত্রে দল এ বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।’

এই আসনে (ঢাকা-১০) ভোটার হওয়ার আবেদন করেছেন (৯ নভেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা হলে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে এই আসনে তিনি প্রার্থী হতে পারেন, এমন আলোচনাও আছে। তবে তিনি এই আসন থেকেই নির্বাচন করবেন কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

৯ নভেম্বর ধানমন্ডি থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভোটার হওয়ার আবেদন জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা স্বতন্ত্র নির্বাচন করার। তারপর দেখা যাক।’

অন্যদিকে ঢাকা-২০ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী চারজন। তাঁরা হলেন ধামরাই উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তমিজ উদ্দিন, জাতীয়তাবাদী যুবদলের ঢাকা জেলা সভাপতি ইয়াসিন ফেরদৌস (মুরাদ), জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ ও ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক নাজমুল হাসান (অভি)। তাঁদের মধ্যে তমিজ উদ্দিন ও ইয়াসিন ফেরদৌসকে নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে।

আমার নামে ৩২৯টি মামলা। দুটি মামলায় সাজা হয়েছে। আড়াই বছর জেলে ছিলাম। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে।
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন

একজনকে ঠেকাতে তিন নেতার ‘জোট’

বৃহত্তর উত্তরার ঢাকা-১৮ আসনটি জোটের শরিক, নাকি দলীয় প্রার্থী দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্তে এখনো নিতে পারেনি বিএনপি। এই আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন। রাতের ভোট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেই নির্বাচনে তিনি বড় ব্যবধানে হেরে গেলেও ৭২ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এবারও তাঁকে সেখানে প্রার্থী করা হবে কি না, নিশ্চিত নয়। এই আসনে এবারও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কোনো দলের নেতাকে প্রার্থী করার বিষয়টি আলোচনায় আছে।

এই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে চারজনকে নিয়ে আলোচনা বেশি। তাঁরা হলেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান (সেগুন) ও এম কফিল উদ্দিন এবং সদস্যসচিব মোস্তফা জামান। ২০২০ সালের উপনির্বাচনে এই আসনে (সাহারা খাতুনের মৃত্যুর পর) বিএনপি প্রার্থী করেছিল এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনকে। ওই নির্বাচনেও কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।

এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নামে ৩২৯টি মামলা। দুটি মামলায় সাজা হয়েছে। আড়াই বছর জেলে ছিলাম। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে।’

স্থানীয়ভাবে আমরা যারা আছি, তারা দেখলাম একটা লোক এখানে এসেছে। ওই ব্যক্তির লোকজনের বিরুদ্ধেই এলাকায় নানা ধরনের অভিযোগ। সে জন্য আমরা এক হয়েছি
এম কফিল উদ্দিন

স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ১০ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহত্তর উত্তরায় বিএনপিতে বিভক্তি রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে সেটি আরও বেড়েছে। এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনকে ঠেকাতে অন্য তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী একজোট হয়েছেন। সম্প্রতি এই তিনজন এক মঞ্চে বক্তৃতাও করেছেন।

তিনজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে এম কফিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে আমরা যারা আছি, তারা দেখলাম একটা লোক এখানে এসেছে। ওই ব্যক্তির লোকজনের বিরুদ্ধেই এলাকায় নানা ধরনের অভিযোগ। সে জন্য আমরা এক হয়েছি।’

উত্তরা বিএনপির একজন নেতা জানান, একজোট হওয়া তিন নেতা এখন চাইছেন এই আসন থেকে মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ) প্রার্থী হোক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই স্নিগ্ধ। তিনি সম্প্রতি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন।

কাফরুল এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৫ আসন গঠিত। এখানে বিএনপি প্রার্থী করেছে শফিকুল ইসলাম খানকে (মিলটন)। এই আসনেও প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

কিছু আসনে ক্ষোভ-বিক্ষোভও আছে

যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে কিছু আসনের প্রার্থী নিয়ে বিতর্ক বা প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে।

ঢাকা-১২ আসনে গতকাল শনিবারও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুজ্জামানের অনুসারীরা। যদিও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল, শেরেবাংলা নগরের একাংশ নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপি প্রার্থী করেছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলমকে (নীরব)।

এখানে প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশ বিক্ষোভের পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেছেন বলেও জানা গেছে।

কাফরুল এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৫ আসন গঠিত। এখানে বিএনপি প্রার্থী করেছে শফিকুল ইসলাম খানকে (মিলটন)। এই আসনেও প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই খালি আসনগুলোতে মনোনয়ন ঘোষণা করা হবে। আর যে আসনগুলোর প্রার্থী নিয়ে বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, সেগুলোতে পরিবর্তন আসতে পারে।