সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ‘নির্বাচনি জোট’ গঠনের পরিকল্পনা বাতিল করে নির্বাচনি আসন ভিত্তিক সমঝোতা করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টার পর দলটির আসন সমঝোতার ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষ করে এটি কোনো ‘বিশেষ’ বা ‘গোপন কৌশল’ কিনা সেই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।
কারও কারও ধারণা, বেশি দলের আলাদা অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনটি যাতে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে মানুষের কাছে বিবেচিত হতে পারে, সেজন্যই এমন কৌশল নিয়েছে দলটি।
তাদের মতে, বিএনপিও সমমনাদের জন্য সুনির্দিষ্ট আসন রেখে দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করায় এখন জামায়াতও একই পথে হাঁটতে যাচ্ছে।
যদিও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তাদের সিদ্ধান্ত হলো প্রচলিত কাঠামোগত জোট না করে সমমনাদের সঙ্গে বসে তারা নিশ্চিত করবেন যাতে একই আসনে তাদের একাধিক প্রার্থী না হয়।
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামী ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে ছিল। জোটবদ্ধ নির্বাচনের পর ওই জোট ক্ষমতায় আসলে দলটির দুজন শীর্ষ নেতা জোট সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে বিএনপি।
আসন সমঝোতা ও নানা আলোচনা
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) সংসদ নির্বাচন, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা সাতটি দল।
এ কারণেই ধারণা করা হয়েছিল যে এসব দলকেই নিয়েই হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি জোট হবে জামায়াতের।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বুধবার সিলেটে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো জোট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, আমরা কোনো জোট করার সিদ্ধান্ত নেইনি এবং আমরা কোনো জোট করব না। এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। আমরা নির্বাচনি সমঝোতা করব। প্রতিটি জায়গায় একটি বাক্স হবে। সেই নীতিতেই আমরা এগুচ্ছি। যদিও ২০২৪ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে ‘এক প্ল্যাটফর্মে’ আনা যায় কিনা তা নিয়ে দলের ভেতরে বাইরে আলোচনা শুরু করেছিল জামায়াত।
বিশেষ করে ‘ইসলামপন্থি’ হিসেবে দাবি করা যেসব দল অল্প পরিসরে হলেও নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে এবং দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘সময় ও অবস্থান ভেদে’ তাদের কিছুটা প্রভাবও তৈরি হয়েছে–– এমন দলগুলোকে ঘিরেই তাদের এমন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় দল হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে বরিশালে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের ‘সৌজন্য সাক্ষাতের’ পর ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নির্বাচনি জোটের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিল।
এরপর বেশ কিছু দলের সঙ্গে আলোচনার পর মোটামুটি আটটি দলের সঙ্গে তাদের নির্বাচনি ঐক্যের প্রক্রিয়া অনেকদূর অগ্রসর হলেও আনুষ্ঠানিক জোট গঠন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান ছিল না।
কিন্তু এর মধ্যেই সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন ও প্রতীক স্থগিত করায় এটি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে এই নির্বাচনে শুধু বিএনপি ও জামায়াত এবং তাদের সমমনারাই অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
অবশ্য এর আগে চলতি বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকায় নিজেদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে শুরু করেছিল জামায়াতে ইসলামী। যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে দলটি তাদের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা এখনো প্রকাশ করেনি।
দলটির নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারাও বিএনপির মতো কিছু আসন সমমনাদের জন্য রেখে দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন। একই সঙ্গে সমমনাদের যেসব আসন দেওয়া হবে সেখানে এর মধ্যে জামায়াতের দলীয় প্রার্থীর নাম স্থানীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়ে থাকলেও তিনি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হবেন না কিংবা সরে দাঁড়াবেন।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তাদের পরিকল্পনায় গোপন কোনো বিষয় নেই। এখানে জোট হতে যে সাংগঠনিক কাঠামোর দরকার হয় সেটা আমরা করছি না। আমাদের যে সমমনা দলগুলো তাদের সবারই চিন্তা হলো যে প্রচলিত কাঠামোর জোটের প্রয়োজন নেই। আমরা সবাই ঘরোয়াভাবে বসে নিশ্চিত করবো যে আমাদের এক আসনে একাধিক প্রার্থী হবে না।
জামায়াতের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই আলোচনায় থাকা খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদেরও বলেন, তারা সবসময়ই আসন সমঝোতার বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করে এসেছেন। রু থেকেই আমাদের চিন্তা হলো আমাদের ভোট যেন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি না হয়। সেজন্য আসনভিত্তিক সমঝোতার কথাই শুরু থেকে বলছি আমরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়াদিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলেন, জোটের চেয়ে আসন নিয়ে সমঝোতাকেই দলগুলো নির্বাচনি কৌশল হিসেবে নিচ্ছে, কারণ জোট হলে নির্বাচনের পরেও নানা বিষয়ে সমঝোতা করতে হয়। জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলো হয়তো চিন্তা করছে জোটের নামে কোনো কমিটমেন্ট আদায় নয় বরং আসনগুলোতে নিজেদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি না হোক। তাতে সবারই নিজ নিজ অবস্থান সুদৃঢ় হবে। আবার নির্বাচনেও অনেক দলের আলাদা অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। ফলে কেউ সরে গেলেও নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
অর্থাৎ এবারের নির্বাচন বিএনপি ও জামায়াত এবং তাদের সমমনাদের মধ্যে হলেও সেটি যেন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে ওঠে সেজন্যও আলাদাভাবে সব দলের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত ও সমমনা দলগুলো।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি ও জামায়াতসহ অনেক রাজনৈতিক দল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতের ২২ জন প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন।
এর আগে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছিল। এবার চলতি বছরের শুরু থেকেই স্থানীয়ভাবে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করতে শুরু করে দলটি। এখন সমমনাদের সঙ্গে আসনভিত্তিক সমঝোতা হওয়ার পর শিগগিরই দলের প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রীয়ভাবেও ঘোষণা করা হবে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।