ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করতে নিয়ম অনুযায়ী এখনো অনেকটা সময় বাকি। তবে এরই মধ্যে সরগরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দিন-রাত চষে বেড়াচ্ছেন নিজেদের নির্বাচনী এলাকা। পথসভা, মতবিনিময়, সামাজিক ও দলীয় অনুষ্ঠান আর গণসংযোগে নির্বাচনী আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এর মধ্যেও ভীতি ছড়াচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অপব্যবহার। সঙ্গে উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের স্থাপনা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এমন উদ্বেগের মধ্যেই গত বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচনী জনসংযোগে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হন বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ। চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও চালিতাতলী খন্দকারপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে আরও তিনজন আহত হন। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যুও হয়। এরশাদ উল্লাহ চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী। ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই বুধবার মধ্যরাতে চট্টগ্রামের রাউজানে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। পাশাপাশি সীমান্তের ফাঁক গলে যাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দেশে ঢুকতে না পারে, সেজন্য সীমান্ত এলাকাগুলোতে আরও কঠোর নজরদারি করতে হবে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের পতনের পর পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়াও সন্ত্রাসীদের কাছে থাকা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে পুলিশের নানা মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সারা দেশে মাঠ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে তাগাদা দিয়েছেন। পাশাপাশি লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের বিষয়ে তথ্যের বিনিময়ে বড় অঙ্কের পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বিশেষ অপরাধ পর্যালোচনা সভায় যোগ দিয়ে থানা থেকে লুট হওয়া বা হারানো বা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ত্বরান্বিত করতে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওই সভায় আইজিপি বাহারুল আলম নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। তিনি এক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ওপর জোর দেন। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর
সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠান শেষে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এরকম উদ্ধার হতেই থাকবে এবং নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে অস্ত্র উদ্ধার আরও বাড়তে থাকবে এবং একসময় দেখবেন, বাইরে আর কোনো অস্ত্র বা হাতিয়ার নেই।’
গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন কালবেলাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, সারা দেশে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশের বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অপব্যবহার ঠেকাতে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তবে পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ঝটিকা মিছিলসহ নানা ধরনের ‘অপতৎপরতা’ ঠেকাতে পুলিশকে বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে। এতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আলাদা করে জোর দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার পর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোর দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের স্থাপনাগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৫৮টি গোলাবারুদ লুট হয়। এর মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ হাজার ৪২১টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৩ লাখ ৬৯ হাজার ১৮৪টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। তবে এখনো বিভিন্ন ধরনের এক হাজার ২০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭৪টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আগামী নির্বাচনে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের অপব্যবহার নিয়ে খোদ পুলিশ সদর দপ্তরও চিন্তিত। এ জন্য লুণ্ঠিত এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে প্রকৃত সন্ধানদাতাদের জন্য আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। লুণ্ঠিত এলএমজির সন্ধান দিলে ৫ লাখ টাকা, এসএমজির সন্ধান দিলে দেড় লাখ টাকা, চায়না রাইফেলের সন্ধান দিলে এক লাখ টাকা এবং পিস্তল ও শটগানের সন্ধান দিলে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য পাঁচশ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রকৃত সন্ধানদাতা নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে পারবেন এবং সন্ধানদাতার পরিচয় গোপন রাখা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তথ্য দিয়ে সহায়তার আহ্বান জানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির গোয়েন্দা তৎপরতা ও অভিযান বাড়ানোর কথাও জানানো হয় তখন। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫টির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র, অন্তত ১ হাজার গুলি, গ্রেনেড ও বিস্ফোরক সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৪টি ৭ পয়েন্ট ৬২ ব্যারেলের চায়না রাইফেল, একই ব্যারেলের একটি রাইফেল, ৭ পয়েন্ট ৬২ ব্যারেলের ৩১টি এসএমজি, ৩টি এলএমজি, ৭ পয়েন্ট ৬২ ব্যারেলের ২০৭টি পিস্তল, ৯ পয়েন্ট ১৯ মিলিমিটারের ৪৪৫টি পিস্তল এবং ১২ বোরের ৩৯৩টি শটগান বেহাত রয়েছে। এ ছাড়াও এক হাজার ১৬৮টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের টিয়ারশেল ও গ্যাস গান বেহাত রয়েছে।
এদিকে গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে একটি ট্রেনের বগিতে অভিযান চালিয়ে ৮টি বিদেশি পিস্তল, ১৬টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড গুলি, প্রায় আড়াই কেজি গান পাউডার এবং সোয়া দুই কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে ঢাকায় ঢুকছিল।
ট্রেনের বগি থেকে ৮ পিস্তল উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের মামলাটি রেলওয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। রেলওয়ে পুলিশের এসপি আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তদন্তে মনে হয়েছে, অস্ত্রগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকেছে। এগুলোর গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পারলেও ধারণা করা হচ্ছে সহিংসতার জন্য অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিল। পাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র এক ধরনের হুমকি। সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা অবৈধ অস্ত্র ছাড়াও পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে, সম্প্রতি বিমানবন্দরে ভল্ট ভেঙে অস্ত্র লুটের তথ্য এসেছে, এসব অস্ত্র উদ্ধারের খবর নেই। এগুলো উদ্ধার করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে।
এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে, গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। তবে সে ধরনের কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রামে নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীর ওপর গুলির ঘটনা অন্য এলাকায় যারা প্রার্থী রয়েছেন, তাদের জন্য ভয় এবং শঙ্কার পরিবেশ তৈরি করেছে। একজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হলেও এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই সব প্রার্থীর মধ্যে থাকবে। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশের জন্য অন্তরায়।
তিনি বলেন, থানা থেকে লুট হওয়া ৩০ শতাংশ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। অভিযোগ আছে, সীমান্ত দিয়ে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করেছে। এ অস্ত্রগুলো আমাদের নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। তাই লুট হওয়া যেসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি এবং যেসব অস্ত্র সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে, সেগুলো জব্দ করতে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন।