Image description

জুলাই সনদ ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে বিভাজন, বিরাধিতায় আর কোনো আড়াল নেই। বরং দুটি পক্ষের বিরোধ এখন প্রায় সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে। একদিকে দেশের প্রধানতম দল বিএনপি, বিএনপি সমমনা এবং বামদলগুলোসহ বেশির ভাগ দল। বামদলগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশসহ সার্বিক পরিস্থিতি দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে এই সনদ ও এর বাস্তবায়নের প্রস্তাবের পক্ষে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আটটি দল-উপদল। এই আটটি দল-উপদলের মধ্যে এনসিপি সরাসরি যুক্ত না থাকলেও দাবির ক্ষেত্রে প্রায় একই অবস্থানে থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হয়ে দেশে যদি কোনো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হয়, সে দায় আপনার কাঁধে বর্তাবে। আর সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে  ‘বিরোধ তীব্র পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বোধ হয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এ ছাড়া বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী উত্তেজিত ভূমিকায় সরকার কী করবে বুঝতে পারছে না।
 
গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এ মন্তব্য করেন।

রাজনীতির  বিরোধপূর্ণ এই  ঘূর্ণাবর্তের কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষিত সময়ের মধ্যে হবে কি না তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা সর্বত্র।  নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্য এ জল্পনা-কল্পনার মাত্রা বাড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা তাঁর রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায় নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বলেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে।

ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে।’ অবশ্য তিনি এ কথাও বলেন, ‘যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক, আমাদের সেটা অতিক্রম করতেই হবে।’

নির্বাচন কমিশন যখন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে, তখন এই নিশ্চয়তা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টাও চলমান। 

গত ১৯ অক্টোবর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া তাঁর ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আরো এক-দুই বছর থাকবে। তারপর বিএনপির ক্ষমতা আরোহণের সম্ভাবনা।’ অবশ্য বিএনপি পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারবে কি না সে বিষয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে আরো লিখেছেন, ‘যদি বিএনপি তার বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত সহিংসতাবিরোধী  আন্দেলন দমনে ব্যর্থ হয়, তবে ১/১১-এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে।’ তাঁর এই পোস্টটির শেয়ার হয়েছে ২১৮টি। আর মন্তব্য করেছেন ৪৪৯ জন। এতে অনেকে প্রতিবাদমূলক  মন্তব্যও  করেছেন। একজন  লিখেছেন, ‘এই অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারির পর কোনো অবস্থাতেই থাকার দরকার নেই। তাহলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ আরেকজনের মন্তব্য, ‘আরো এক-দুই বছর থাকলে দেশ থাকবে স্যার?’

দলগুলো যা বলছে : গত কয়েক দিন ধরে বিরোধ-বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা ‘জুলাই সনদ’ সম্পর্কে গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলকভাবে জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থ ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা। ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ জারির এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। প্রস্তবিত ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ, গঠন নিয়েও বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত; সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে—এ প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হাস্যকর বলেও জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলে দিয়েছে, ‘সংসদ নির্বাচন ঠিক সময়ে না হলেও আগে নভেম্বরেই গণভোটের ব্যবস্থা এবং আজ শুক্রবারের মধ্যেই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গতকাল বলেছেন, ‘আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। দেশ অন্য পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইলেকশন দেন। আপনি যদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইলেকশন না দিতে পারেন, তাহলে পরে যদি কোনো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি হয়, সে দায় আপনার কাঁধে বর্তাবে।’

বিভিন্ন দলের উদ্বেগ

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবকে জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া সংবিধানবিরোধী, অগণতান্ত্রিক এবং জনগণের মতামত ও প্রতিনিধিত্বের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ।’ তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মুখে বললেও তারা আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় না। সে কারণেই সরকারের উপদেষ্টারা বড় ধরনের আঘাত ও আশঙ্কার কথা বলছেন। তাঁরা যেকোনো অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত করতে চান। কিন্তু দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের স্বার্থে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর জরুরি।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশসহ সার্বিক পরিস্থিতি দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘সনদ বাস্তবায়নের এমন প্রস্তাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তার পরও ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এখনো চূড়ান্ত নয়। সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমরা আশাবাদী। সরকার বিশেষ কোনো দলের প্রতি ঝুঁকে গেলে শুধু দেশের মানুষই নয়, বরং সরকার নিজেও বিপদে পড়বে।’ সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিপদ বাড়বে, নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সরকার ভিন্নপথে হাঁটার চেষ্টা করলে সংকট বাড়বে।

গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘রাজনীতির বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পথরেখা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। উপদেষ্টারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে আনাড়ি। দেশের মানুষের লড়াই এক দলের বদলে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া নয়। বরং এই লড়াই সমাজকে বদলে দেওয়ার। দুই মাস পর নির্বাচন হয়ে গেলে সরকারের উপদেষ্টাদের পাওয়া যাবে না। এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুদ্ধির সঙ্গে কাজ করতে হবে। না হলে ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে।’

পরিস্থিতি জটিল করে নির্বাচনকে পেছানোর চেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী। তিনি বলেন, ‘কোনো বিশেষ পক্ষকে খুশি করতে ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্যকে হুমকির মুখে ফেলছে বলেও জনগণের ভেতরে ধারণা তৈরি হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও জাতীয় স্বার্থের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ ঐকমত্য কমিশনের কিছু সুপারিশ কমিশনের বৈঠকের আলোচনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং কিছু সুপারিশ গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতির অনুসরণ করে না। এই সুপারিশগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করছে, যেটা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সম্ভাবনাকে আশঙ্কার মুখে ফেলছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, অবিলম্বে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান করুন।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নসংক্রান্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল—বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটা অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়েছে, যা গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে কোনোভাবেই ধারণ করে না। আমরা এই অগণতান্ত্রিক পথে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সমর্থন করি না। এই প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে জুলাই সনদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং একটা সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেবে।’

বিশেষজ্ঞ মত : সার্বিক এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন মনে করেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কারগুলো কার্যকর করতে একটি বিশেষ আদেশ বা অধ্যাদেশ জারি করার পর গণভোট অনুষ্ঠান ও ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ বিষয়ে যে প্রস্তাব করেছে তা নিয়ে এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।

তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিশনের এই প্রস্তাবের বিষয়ে বিএনপি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে তাতে জানা যায়, যে সনদে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছিল তার সঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের খসড়ায় অসংগতি রয়েছে। অন্যদিকে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে সাধারণ নির্বাচনের আগেই গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি করছে। যার ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হলো—প্রথমত, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের স্বাভাবিক পদ্ধতি সংসদের মাধ্যমে, অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু এখানে ‘গণভোট’কে কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে স্থাপন করে প্রস্তাবটি জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গণভোটে সমগ্র প্রস্তাবটির ওপর ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ভোট দিয়ে তাঁদের মতামত জানাবেন। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন আছে—১. ভোটারদের সবাই কি জুলাই সনদের প্রস্তাব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল রয়েছেন? প্রস্তাবের কোনো কোনো বিষয় নিয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকলে তিনি কী করবেন? দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল সনদের যেসব প্রস্তাবের বিষয়ে দ্বিমত জানিয়েছে, সেসব বিষয়ের সমাধান কিভাবে হবে?

দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবের ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হওয়া’ ধারা একটি ব্যতিক্রমধর্মী সাংবিধানিক কৌশল। সংসদ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তবে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে—এটি সংসদীয় সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাস্তবে এই প্রক্রিয়া কিভাবে সাংবিধানিক বৈধতা পাবে, সেটি বড় প্রশ্ন।

তৃতীয়ত, কমিশনের প্রস্তাবে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’কে বিশেষ আদেশের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে রাজনৈতিক বৈধতার নতুন উৎস খোঁজা হয়েছে। কিন্তু সংবিধান সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবের যেসব বিষয়ে ভিন্ন রয়েছে সেগুলো কিভাবে সমাধান করা হবে খসড়া প্রস্তাবে তার কোনো উল্লেখ নেই।’

তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক আলী রীয়াজ তাঁর একটি গ্রন্থে (নিখোঁজ গণতন্ত্র, প্রথমা প্রকাশন) উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক প্রকার ‘নিখোঁজ’ অবস্থায় আছে। বিগত সরকারের নির্বাচন নির্বাচন খেলা নিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে  গণতন্ত্রের বাহ্যিক কাঠামো টিকে থাকলেও তার প্রাণশক্তি অর্থাৎ অংশগ্রহণ, জবাবদিহি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় সেই একই প্রবণতার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। গণভোট যদি কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যায়, তবে পুরো প্রক্রিয়া তার গণতান্ত্রিক তাৎপর্য হারাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এই বিরোধ হতাশাজনক। জাতীয় নির্বাচনটা হওয়া খুব জরুরি। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন বানচালে বড় শক্তি চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছেন। এটা উদ্বেগের বিষয়। এ অবস্থায় চব্বিশের গণ-আন্দোলনের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে বিরোধ সংকট বাড়াবে। সরকারের উচিত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করা। দলগুলোরও উচিত দেশের স্বার্থে নিজের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসা। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে দলগুলোকে সংলাপে বসতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বড় সমস্যা হচ্ছে—বর্তমান সরকার বিপ্লবী সরকার না। সে কারণে এই সরকারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিল্পবী সরকার হলে এ প্রশ্ন উঠত না। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, গণ-আন্দোলনে হাজারো ছাত্র-জনতা জীবন হারিয়েছেন, অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বহন করেছেন। তাঁদের জন্য ভুলত্রুটি সংশোধন করে হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।’