আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা একদল তরুণ ১৯৭২ সালের অক্টোবরে গঠন করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। সে সময় ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি ও প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিকেও সামনে নিয়ে এসেছিল জাসদের তরুণ কর্মীরা। আবার আশির দশকের শুরুর দিকে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে জাসদের দাবি ও প্রস্তাবগুলো বেশ আলোড়ন তোলে।
কয়েক দশক পর এখন আবারো জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্র সংস্কার। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য গঠন করেছে বিভিন্ন কমিশন। সত্তর ও আশির দশকে জাসদ ছাত্রলীগের যে তরুণরা রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি তুলেছিলেন, তাদের একাংশ এখন এসব সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। আবার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন রয়েছেন কেউ কেউ। সত্তর ও আশির দশকের সেসব তরুণের মধ্যে যারা এখন সরকার ও সংস্কার কমিশনগুলোয় উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব পালন করছেন; তারা হলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ, প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী, গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন প্রমুখ।
গত সপ্তাহেই রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত কয়েকটি কমিশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। এসব প্রতিবেদনে উঠে আসা নানা প্রস্তাবে পাঁচ দশক আগে জাসদের পক্ষ থেকে তোলা রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিগুলোর কিছু হলেও প্রতিফলন দেখা গেছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।
একসময়ের জাসদ ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ছাত্র সংগঠনটির নেতা হিসেবে ১৯৭৯-৮০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হন। সে সময় জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক দর্শন তৈরিতে নেয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উনারা জাসদের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। একটি বিষয় হলো সে সময় জাসদ রাজনীতিতে বিপ্লব চেয়েছিল। বিদ্যমান ব্যবস্থার উন্নতি নয়, বরং আমূল পরিবর্তন করা। যার জন্য জাসদ গঠনের পর সবাইকে এ বিষয়গুলোয় আলাদা পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে নানান কারণে সেটি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত। সে সময় তিনি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদে জাসদ ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচন করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকেন। জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৩-৮৪ সালের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
সংবিধান সংস্কারে সরকারের গঠিত কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজও ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৯-৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮০-৮১ সালে ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক পদে জাসদ ছাত্রলীগ থেকে বিজয়ী হন। যদিও পরে জাসদের রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংবিধান, নির্বাচন, দুদক ও পুলিশ—এ চারটি সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন শাসন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আইনসভাকে এক কক্ষের পরিবর্তে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) হবে নিম্নকক্ষ। আরেকটি হবে উচ্চকক্ষ বা সিনেট। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর। আর ২১ বছর বয়সে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। দেশের বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল স্তম্ভ হিসেবে চার মূলনীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এর মধ্যে শুধু ‘গণতন্ত্র’ বহাল রেখে বাকিগুলো বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এর পরিবর্তে নতুন চারটি মূলনীতি যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে, সংস্কারকৃত সংবিধানের মূলনীতি হবে পাঁচটি। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
১৯৭২ সালে জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। সে সময় দলটির উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা। পরে ১৯৮০ সালে ১৮ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে জাসদ। সে কর্মসূচিতে বিস্তারিতভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের বেশকিছু দাবি তোলা হয়। পরে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান সম্প্রসারিত গণতন্ত্র বা অংশীদারত্বের গণতন্ত্রের ধারণাটি নিয়ে আসেন। যেখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাসহ আরো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে জাসদ। ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে স্থানীয় সরকারে রূপান্তর করা, বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, হাইকোর্টকে প্রাদেশিক পর্যায়ে পৌঁছানো, নিম্ন আদালতকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিয়ে আসা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠন এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করার কথাও সে সময় উল্লেখ করা হয়।
জাসদের সংস্কার প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (রব) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির জন্য যে সংবিধান দরকার ছিল তা ১৯৭২ সালে হয়নি। যার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তর করার জন্য জাসদ অনেকগুলো কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম জাসদই রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তা করে। যেখানে এসব চিন্তা না করে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা পালাবদলের রাজনীতিই করে গেছে। কিন্তু ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার রূপান্তরের জন্য যে রাষ্ট্র সংস্কার দরকার সেটিই আমরা করেছি। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে সব অংশীজনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা জাসদ বলেছে। এটিকে আমরা বলি অংশীদারত্বের গণতন্ত্র। অর্থাৎ শুধু রাজনৈতিক দলের শাসন কায়েমের পাশাপাশি সমাজ শক্তিগুলো অদলীয় ভিত্তিতে তাদেরও রাজনীতি ও ক্ষমতায় অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা। আমরা মনে করি ভিত্তির কাজটি আমরা করেছি, যা আজকের রাজনীতিতে এজেন্ডা হয়ে উঠল। ধারণাগতভাবে আমাদের বিষয়গুলো সংস্কার কমিশনে এলেও পুরোপুরি আসেনি। আগামী দিনে এগুলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ১৯৮৯-১৯৯৪ সালে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানও। ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ১৯৯৪ সালে তিনি জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক হন। এরপর আর জাসদের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না।
মো. আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যারা সংস্কারের প্রস্তাব এনেছেন, তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। সুতরাং এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থাকাকালে জাসদ ছাত্রলীগের মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটনও ছাত্রজীবনে ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো এবং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লবী শক্তি গড়ে উঠেছিল। তারা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার পরপর বিপ্লবী শক্তি জাতীয় সরকার এবং রাষ্ট্র সংস্কারের মতো কতগুলো দফা নিয়ে খুব নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত এটিকে গুরুত্ব দেননি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এটিকে ভয় হিসেবে দেখেছে। এরপর নানা ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে জাসদের জন্ম হয়। সবসময়ই জনগণকে যুক্ত করে একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জাসদ চেষ্টা করে। যার লক্ষ্য গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী শক্তির জাগরণের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন। মাঝপথে সামরিক শাসন এটিকে বাধাগ্রস্ত করে।’
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের কিছু ক্ষেত্রে জাসদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে সুপারিশ আকারে আনা হয়েছে। কিন্তু এটির অবস্থা হলো কালের এক ফোড়ন, অকালের দশ ফোড়নের মতো অবস্থা। অর্থাৎ যখন যেটি করা দরকার সেটি করতে ব্যর্থ হলে ওই জায়গাটি দুর্বল হয়ে যায়। শুধু ঘোষণা থাকলে হবে না, জনমতও থাকতে হবে।’
ছাত্রজীবনের রাজনীতি এখনো প্রভাব ফেলছে কিনা সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই সময়ের চিন্তা-চেতনা, সাংগঠনিক সক্ষমতা, পরিবেশ-পরিস্থিতি—এসব অনুপস্থিত থাকায় তখনকার চিন্তা-চেতনার প্রতিফলনের সম্ভাবনা খুব কম। সামগ্রিক বিবেচনায় সেটির প্রতিফলনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমাদের স্বপ্ন হয়তো ধূসর হয়ে পড়েছে কিন্তু স্বপ্ন দেখা কিন্তু বন্ধ হয়নি। আর সেই স্বপ্ন হলো সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, যেটিকে আমরা মনে-প্রাণে চাই।’