Image description
 

অতি সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চান। তবে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আগে জাতীয় নির্বাচন চায়। দলগুলো মনে করে, এ মুহূর্তে জাতীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে চাইতে পারেন। কিন্তু এই মত এ সময়ের জন্য মোটেও বাস্তবভিত্তিক নয়।

তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও দল। তারা বিবিএসের জরিপের ফলাফলকে যৌক্তিক বলে মনে করছে।নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে গত ডিসেম্বর মাসের ২০ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে জনমত জরিপ পরিচালনা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে বিবিএসের মাধ্যমে এ জরিপ চালিয়েছে।

এই জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চান। বিপরীতে প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ চান দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন একজন দলীয় ব্যক্তি। জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষ। আর সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন ১৩ শতাংশ। বিবিএস ইতিমধ্যে জরিপের খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

অবশ্য এই জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছিল। কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্য। তিনি ৮ জানুয়ারি ঢাকা সফরকারী ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেন, তাঁর সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মূলত তখন থেকেই এ বিষয়ে সতর্ক দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি।

আগে জাতীয় নির্বাচন চায় বিভিন্ন দল

গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় এ বিষয়ে আলোচনার পর দলটির নীতিনির্ধারকেরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৩ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় সিদ্ধান্ত জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে সংসদ নির্বাচন চাই। আমাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। কারণ, এখন তো পুরো দেশের, পুরো জাতির ফোকাসটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন হতে পারেনি। মানুষ সে জন্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথটাকে পূরণ করতে চায়।’

বিএনপি মনে করে, সরকারের দিক থেকে নানাভাবে জাতীয় নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রক্রিয়ার অংশ। সে জন্য দলটির নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েই এ ধরনের চিন্তার সমালোচনা করছেন। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির মহাসচিব তির্যক প্রশ্ন তোলেন, এ রকম ক্রিটিক্যাল সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্য নির্বাচন করার চিন্তাটা আসে কোত্থেকে?

জাতীয় সংসদ, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে—এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি জামায়াতে ইসলামী। তাদের সাংগঠনিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলেও জানা যায়নি। তবে তারা যে কোনো জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে জানান একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি জানান, জাতীয় সংসদ, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে—এ প্রশ্ন জোরালোভাবে সামনে এলে দল এর ভালোমন্দ বিশ্লেষণ করে অবস্থান জানাবে।

তবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়াই ভালো। একটা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সে সরকার স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এটা যদি না হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে যে লড়াই শুরু হবে, সেটা অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’জরিপের সময় বিবিএস মানুষের কাছে কী ধরনের প্রশ্ন করেছিল, মতামত উঠে আসার ক্ষেত্রে তাতে জরিপকারীদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ। এ ছাড়া এ সময়ে নাগরিক সেবা বঞ্চিত বিক্ষুব্ধ মানুষ হয়তো এ ধরনের মতামত দিতেও পারেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিপে কীভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমি জানি না। এ মুহূর্তে মানুষ বিক্ষুব্ধ আছে স্থানীয় সরকারের নাগরিক সেবা নিয়ে। সে কারণে কেউ কেউ এমনটা বলে থাকলে সেটাকে আমি সাধারণভাবেই দেখি। কিন্তু দেশের এখনকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনই আগে করা উচিত। সরকার নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে কাজ করছে। আমি মনে করি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে তারপরই নির্বাচন করা উচিত হবে।’

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণতন্ত্র উত্তরণে কোনটা আগে কোনটা পরে, সেটা চিহ্নিত করতে হবে। নির্বাচনের আগে যে সংস্কারগুলো করা যাবে, সেগুলো শেষ করাই হচ্ছে এখনকার জাতীয় অগ্রাধিকার। আমরা মনে করি, সেদিকেই মনোযোগ বেশি থাকা দরকার। আর কোন নির্বাচন আগে করতে হবে, সেটা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনই মুখ্য মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সব সময়েই ঝামেলার। এখন এ নির্বাচন করতে চাইলে আওয়ামী লীগের মুখচেনা দাগিরাও ঢুকে যাবেন। এতে এলাকাভিত্তিক গন্ডগোল হওয়ার আশঙ্কা আছে। এটা মোকাবিলার করার মতো যে ধরনের সরকার থাকতে হয়, এ সরকার সে রকম জনসম্পৃক্ত সরকার নয়। তাই আগে জাতীয় নির্বাচন হওয়াই উত্তম।

ভিন্নমতও আছে

আবার দলীয় সরকারের অধীন অতীতের স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। সে অভিজ্ঞতা থেকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে মন্দ হবে না বলেই মনে করে।

চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা হলো, দলীয় সরকারে অধীন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না। এবার সে আশঙ্কা থাকা উচিত নয়। কারণ, নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারের পরই তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে। বিবিএসের জনমত যদি সঠিক হয়, তাহলে আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে মন্দ হবে না। এতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বোঝা যাবে।’

আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এ সংগঠনের মুখপাত্র সামান্তা শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার কার্যকর না থাকায় জনভোগান্তি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলাও ঠিকমতো কাজ করছে না। বিবিএসের জরিপের ফলাফলে আমাদের দাবির যৌক্তিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে। আগামী দিনে যৌক্তিক নির্বাচন হচ্ছে গণপরিষদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া যৌক্তিক।’

‘সরকারের ইচ্ছার ইঙ্গিত’

বিবিএসের মাধ্যমে পরিচালিত ওই জরিপের মতামতগুলো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছে। এতে এ বিষয়ে সরকারের ইচ্ছার ইঙ্গিত রয়েছে, এমন আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এদিকে এই জরিপের পদ্ধতি ব্যাখ্য করে বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে নমুনায়নের মাধ্যমে ৪৬ হাজার ৮০টি সাধারণ খানা (পরিবার বা যাঁরা এক চুলায় রান্না করেন) থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বছর বা তাঁর বেশি বয়সী নাগরিকদের মধ্যে ‘কিশ গ্রিড সিলেকশন’ পদ্ধতিতে একজন নির্বাচিত উত্তরদাতার কাছ থেকে নির্ধারিত প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়, অর্থাৎ ৪৬ হাজার ৮০ জন মানুষ এই জরিপে অংশ নিয়েছেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে জনগণের মতামত জানার লক্ষ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। কারণ, গণতন্ত্রে জনমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ বিবিএসের এই জরিপ কতটা মানসম্পন্ন, নির্ভরযোগ্য—সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাদের ডেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থাৎ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সে রকম হলে বিপজ্জনক ব্যাপার। তবে বিষয়টি রাজনৈতিক, পরিসংখ্যানের বিষয় নয়। আর যদি বিবিএসের জরিপে ফলাফল সঠিক হয়, তাহলে আমি বলব, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা আছে। কেন সংসদ নির্বাচন আগে হওয়া উচিত, তারা জনগণকে বোঝাতে পারেনি।’