Image description
 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের থানা, ফাঁড়িসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বিপুল অস্ত্র, গুলি লুট করা হয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকেও অস্ত্র-গুলি লুট হয়। এ ছাড়া সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের বাসা থেকেও লাইসেন্স করা অস্ত্র-গুলি লুট হয়। এসব লুটের অস্ত্র হাতবদল হয়ে পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে চলে গেছে। যেসব অস্ত্র সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল, এমনকি খুনোখুনিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কারণে লুটের অস্ত্র এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও আন্ডারওয়ার্ল্ড সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের থানা, ফাঁড়িসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা থেকে বিভিন্ন ধরনের ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ রাউন্ড গুলি লুট হয়। এসব অস্ত্র-গুলির বেশিরভাগই লুট করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ও দলীয় ক্যাডাররা। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা যেসব অস্ত্র-গুলি লুট করে তা কম দামে বিভিন্ন অপরাধী গ্রুপের কাছে বিক্রি করে। এসব অস্ত্র আবার হাতবদল হয়ে চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে। রাজধানীর গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে যেসব অস্ত্র-গুলি লুট হয়েছে, সেসবের বেশিরভাগই জেনেভা ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা করে। পরে তারা লুট করা অস্ত্র কম দামে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে বিক্রি করে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আবার সেই অস্ত্র পুরনো সহযোগীদের পাশাপাশি নতুন নতুন সন্ত্রাসীর হাতেও তুলে দিয়েছে, যাতে তাদের পুলিশ ও র‌্যাব চিনতে না পারে। ঢাকা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের একটি বড় অংশ শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও পিচ্চি হেলাল বাহিনীর কাছে গেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর এই দুই সন্ত্রাসী দল গুছিয়ে শুরু করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি। তাই তাদের ধরতে এখন র‌্যাব-পুলিশের অভিযান চলছে।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কারাবন্দি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীরা একে একে বেরিয়ে আসে। এ তালিকায় রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, হাবিবুর রহমান তাজ। তাদের অধিকাংশই নতুন করে অপরাধে যুক্ত হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। তাদের হাতেও এসেছে লুটের অস্ত্র।পুলিশসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, লুণ্ঠিত অস্ত্র হাতবদল হয়ে সুন্দরবন এলাকার জলদস্যু, তিন পার্বত্য জেলায় তৎপর বিভিন্ন গ্রুপের হাতেও গেছে। এখনও লুুণ্ঠিত অস্ত্র অপরাধজগতে বেচাকেনা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অস্ত্রই আবার খুনোখুনি থেকে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বেহাত অস্ত্র র‌্যাব-পুলিশের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের ৪৬০টি থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে ১১৪টি থানা-ফাঁড়িতে। এর মধ্যে শুধু আগুন দেওয়া হয় ৫৮টি থানায়। ঢাকা মহানগরে ১৩টি থানা আক্রান্ত হয়। সরকার পতনের পর সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে চাইনিজ রাইফেল ১১০৬টি, ১২ বোরের শটগান ২ হাজার ৭৬টি, ৯ এমএম পিস্তল ১ হাজার ৯২টি, ৫৩৯টি চাইনিজ পিস্তল রয়েছে। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। এখনও ১ হাজার ৩৯২টি লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ রাউন্ড গুলির মধ্যে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২১৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। এখনও ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়নি।পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, লুুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে ইতোমধ্যে ৭৬ শতাংশ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিগুলো উদ্ধারে পুলিশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রয়েছে। অবৈধ একটি অস্ত্রও বাইরে থাকলে সেটা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র গোলাবারুদ যাতে কেউ অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যবহার করতে না পারে, এ জন্য পুলিশের নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত আছে, জানান তিনি।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, লুটের অস্ত্র ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি খুনের ঘটনায় এসব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র যত বেশি সময় উদ্ধারের বাইরে থাকবে, চ্যালেঞ্জও তত বাড়বে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঝুঁঁকি বাড়বে। মানুষের বিরুদ্ধেও এসব অস্ত্র ব্যবহার হবে। আর আগামী নির্বাচনের আগে যদি এসব অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তা হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে; একটা ভয়ার্ত পরিবেশ সৃর্ষ্টি হবে।তৌহিদুল হক বলেন, একজন অপরাধীর কাছে অস্ত্র থাকা মানে হচ্ছে, তার অপরাধ করার ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া। এখন জোরালো অভিযান চালিয়ে অস্ত্রগুলো উদ্ধারই একমাত্র সমাধান।

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২২ আগস্ট নরসিংদীর রায়পুরার শ্রীনগর ইউনিয়নের সায়দাবাদ এলাকায় সাবেক ইউপি মেম্বার ফিরোজ মিয়া ও আবু হানিফ জাকারিয়ার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে প্রতিপক্ষের গুলিতে ফিরোজ অনুসারী ছয়জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হন। এ ঘটনায় ব্যবহার হয় নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র। গত বছর নভেম্বরে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সাহিদা ইসলাম রাফা (২২) নামে এক তরুণীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাহিদার প্রেমিক ঘাতক তৌহিদ শেখ তন্ময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি ৫ আগস্ট রাজধানীর ওয়ারী থানা থেকে লুট করা হয়েছিল।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দিন থেকেই রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্পে শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। ৬ আগস্ট গুলিতে মারা যায় এক যুবক। পরে ১৭ থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন, দ্বিতীয় দফায় ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সোহেল গ্যাংয়ের গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। ২২ সেপ্টেম্বর রাত থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ভোর পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শীর্ষ মাদক কারবারি চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম এবং ২৩ সেপ্টেম্বর চারকো ইরফান গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া ২৪ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ সাগর নামে এক কসাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর রাতেও গোলাগুলি হয়। এতে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এসব ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের বেশিরভাগই গণভবন, মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে লুট করা। পরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে জেনেভা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আসে।