
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শতবর্ষী নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিএনপির ইউনিয়ন সভাপতির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মুনীর হোসেন (মনির)।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে এ হামলার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, নাকোল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতির নেতৃত্বে সংগঠিত এই হামলায় জড়িত ছিলেন বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক শেখ আব্দুল মান্নানের অনুসারীরা, শিক্ষক প্রতিনিধি, বিএনপি-যুবদলের নেতাকর্মী, স্থানীয় মাদক কারবারি ও কিশোর গ্যাং সদস্যরা। ঘটনার পর বিদ্যালয় এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সোমবার বিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধভাবে ‘মব’ তৈরি করে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের মধ্যে ছিলেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক শেখ আব্দুল মান্নানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শিক্ষক প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সাইমন, মিরান হত্যা মামলার পলাতক আসামি ও নাকোল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মহব্বত, ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি রবিউল ইসলাম, সানরাইজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল ইসলাম, যুবলীগ কর্মী কুতুবউদ্দিন লাভলু, আরও কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ও কিশোর গ্যাং সদস্য।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুবর্ণা জামান ও লিপি বেগম অভিযোগ করেন, হামলাকারীরা শুধু প্রধান শিক্ষক মুনীর হোসেনের ওপরই নয়, দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালায়, ফলে পরীক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীদেরও পরিকল্পিতভাবে উসকে দেওয়া হয়েছিল।
হামলার সময় নাকোল পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মালেক ও আরও দুই পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং আহত প্রধান শিক্ষককে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তবে দুই শতাধিক লোকের হামলার মুখে পুলিশও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়।
বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষ ভাঙচুর করে ল্যাপটপ, ক্রীড়া সামগ্রী ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নষ্ট করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার পর বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান জোর করে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের দখল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান।
বিদ্যালয়ের সভাপতি শিপন মির্জা এ ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘বিদ্যালয়ে চলমান চার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত ঠেকাতেই এই হামলা হয়েছে। বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক ও তার রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস চালিয়েছে। এর দায় কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না।’
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা মিল্টন বলেন, ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি, দুই শতাধিক লোক প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে তার ওপর হামলা চালিয়েছে। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কিছুই করতে পারেনি। এটা সাধারণ মারামারি নয়, এটি ছিল হত্যাচেষ্টা।’
হামলায় গুরুতর আহত প্রধান শিক্ষক মুনীর হোসেন মাগুরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতারা হামলা চালায়। প্রথমে গালাগালি করে, এরপর চেয়ার দিয়ে মাথায় আঘাত করে। মাথা ফেটে রক্ত বের হলে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে ছিলেন বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান এবং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রবিউল ইসলাম। এরা আগে আওয়ামী লীগের সাথে চলাফেরা করলেও এখন বিএনপির নাম ভাঙিয়ে বিদ্যালয়ে ত্রাস সৃষ্টি করছে। আমি আইনের আশ্রয় চাই।’
তবে নাকোল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মহব্বত দাবি করেন, ‘শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষার হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। আমরা কেবল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম, হামলায় জড়িত নই।’
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনার পরপরই বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জুলাই মাসে এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক এবং প্রাক্তন সভাপতির বিরুদ্ধে প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে আসে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে আগস্টে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। বরখাস্তের পর থেকেই তার অনুসারীরা বিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে নানা রকম চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন বলে জানা গেছে।