Image description

দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ নীতি সহায়তা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রাজনৈতিক পরিবর্তনসহ নানা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কারণে বহু প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ব্যবসা চালাতে পারেনি। এর প্রভাব পড়ে ঋণ পরিশোধে, ফলে ঋণ খেলাপি বেড়ে যায় এবং সামগ্রিক ব্যাংক খাত অস্থির হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে পাঠানো এক প্রজ্ঞাপনে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নতুন এ নীতির মূল লক্ষ্য হলো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার টেকসই ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা। এতে যেমন কর্মসংস্থান টিকবে, নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে, তেমনি ব্যাংকের আটকে থাকা ঋণও পুনরুদ্ধার করা যাবে। অর্থাৎ একদিকে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হবে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতও আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এই সুবিধার আওতায় আসতে পারবে। যেমন প্রতিশ্রুত ইউটিলিটি সংযোগ না পাওয়া, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে সমস্যা, টাকার অপ্রত্যাশিত অবমূল্যায়ন, কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান বৈষম্যের শিকার হয়েছে বা অযৌক্তিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাও সুযোগ পাবে। তবে যারা আগে কোনো ধরনের পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন সুবিধা নেয়নি, তারা অগ্রাধিকার পাবে।

 

নীতিমালা অনুসারে, ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বিরূপমানে (এসএস, ডিএফ, বিএল) থাকা ঋণগুলো সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া যাবে।

পুনঃতফসিলের জন্য ঋণগ্রহীতাকে ন্যূনতম ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে। তবে আগে তিন বা ততধিকবার পুনঃতফসিল করা থাকলে ডাউনপেমেন্ট আরও ১ শতাংশ বেশি দিতে হবে।

ঋণ পুনঃতফসিলের পর সুদের হার গ্রাহক ভেদে নির্ধারণ করা যাবে। তবে তা নীতিমালায় উল্লেখিত সর্বনিম্ন হারের চেয়ে ১ শতাংশ কম হতে হবে। কিস্তি মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরিশোধযোগ্য হবে। গ্রেস পিরিয়ড চলাকালে যে সুদ যোগ হবে, তা আংশিক বা সম্পূর্ণ আদায় করা যাবে। তবে যদি কোনো গ্রাহক তিন মাসিক বা এক ত্রৈমাসিক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে আবার নতুন করে ঋণ শ্রেণিকরণ কার্যকর হবে।

নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণগ্রহীতাকে নতুন ঋণ মঞ্জুরি বা বিদ্যমান ঋণসীমা বৃদ্ধি করতে হলে তার সার্বিক অবস্থা ভালোভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সমঝোতা করা অর্থ পরিশোধ না করে নতুন ঋণ দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ গ্রাহক যদি ডাউন পেমেন্ট জমা না দেন, তবে ব্যাংককে তার আবেদন কার্যকর করতে হবে না।

অশ্রেণিকৃত মেয়াদি ঋণগুলো গত ৩০ জুন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত পুনর্গঠন করা যাবে। আবার নিয়মিত ঋণেও বিশেষ এক্সিট সুবিধা দিয়ে অতিরিক্ত এক বছর সময় দেওয়া যাবে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ডাউন পেমেন্ট বাধ্যতামূলক থাকবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো শ্বাস ফেলার মতো সময় পাবে, আর ব্যাংকগুলোও ঋণ আদায়ের পথে এগোতে পারবে।

২০২২ সালে আমদানির জন্য খোলা ইউজেন্স এলসির কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান মুদ্রা বিনিময় হারের অপ্রত্যাশিত ক্ষতির শিকার হয়েছে, সেগুলোও এই সুবিধার আওতায় আসবে। ব্যাংক নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় ক্ষতি হিসাবায়ন করবে এবং ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় দেওয়া হবে।

নীতিমালা অনুসারে, ঋণগ্রহীতারা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন করতে পারবেন। আবেদন পাওয়ার পর ব্যাংককে ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে আবেদন কার্যকর হবে কেবল তখনই, যখন গ্রাহক ডাউন পেমেন্টের অর্থ জমা দেবেন।

৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ রয়েছে—এমন বড় ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আন্তঃব্যাংক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত সম্ভব না হলে “নীতি সহায়তা বাছাই কমিটি”তে বিষয়টি পাঠাতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেছে, জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষিত ঋণ এবং পরিচালক বা তাঁদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ এই সুবিধার আওতায় আসবে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমোদন থাকলে ব্যতিক্রম হতে পারে।

পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠনকৃত ঋণগুলোকে এসএমএ (Special Mention Account) হিসেবে শ্রেণিকরণ করতে হবে এবং পর্যাপ্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। স্থগিত সুদ বা আগের প্রভিশন প্রকৃত আদায় ছাড়া ব্যাংকের আয় হিসেবে গণনা করা যাবে না। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এই ধরনের সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

বিশেষ নীতি সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হবে না। তবে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। আবার একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া থাকলে সর্বোচ্চ ঋণদানকারী ব্যাংক অথবা সম্মতিতে যেকোনো একটি ব্যাংক সভা আয়োজন করে নীতি সহায়তার সিদ্ধান্ত নেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এ নীতি সহায়তা বাস্তবায়িত হলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় ফেরার সুযোগ পাবে, কর্মসংস্থান টিকবে, আর ব্যাংকগুলোর আটকে থাকা ঋণও ধীরে ধীরে আদায় সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা আরও জোরদার হবে।