
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। রপ্তানি আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি, রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আয়, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে এই বছরে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা এবং ডলার সংকট থেকে বেরিয়ে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছে সরকার। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে এসেছে উদ্বৃত্ত, পুঁজিবাজারে ফিরেছে গতি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, অর্থপাচারে ডলার সংকট, রপ্তানি বাজারে নজর না দেওয়ায় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি, ভারতের স্বার্থে নেওয়া কয়েকটি প্রকল্পে বেপরোয়া ঋণ নিয়ে লুটপাট এবং বাজার সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে জুলাই বিপ্লবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা। হাসিনার বিদায়ের সময় অর্থনীতি ছিল ধ্বংসের মধ্যে। এ অবস্থায় নতুন সরকারের কাছে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে আর্থিক খাত এখন অনেকটাই স্বনির্ভর। সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা আর নেই।
তবে অর্থনীতিতে সফলতার পাল্লা ভারী হলেও রাজস্ব আদায়ে শ্লথ গতি চলতি অর্থবছরের বাজেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সেই সঙ্গে সরকারের গেল এক বছরে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ফলে চাকরির বাজার এখনো মন্দা। ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। তবে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় সফলতা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতে এখনো আওয়ামী দোসররা রয়েছেন বহালতবিয়তে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিও কিছুটা কমেছে। যদিও সরকার বলছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আগে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল হাসিনা সরকার। ভুয়া তথ্য দিয়ে জিডিপিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। বর্তমান সরকার সে পথ বাদ দিয়ে প্রকৃত তথ্যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে।
দেশের সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে প্রশ্ন ছিল—আর্থিক খাতে এ সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা কী কী। জবাবে তিনি বলেন, হাসিনা সরকার দেশকে দুর্নীতির একটি উৎসকেন্দ্রে রূপ দিয়ে গেছে। ওই সময়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিষয়টির আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিগত ১৫ বছরে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার গতি হারিয়েছিল। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখছি ঋণের বিশাল একটি বোঝা। আন্তর্জাতিক বাজারের তেল বিক্রেতা টাকা পাবে, বিদ্যুৎ বিক্রেতা টাকা পাবে, ঋণদাতা টাকা পাবে। তাদের একটি বড় চাপ আমরা সামাল দিচ্ছি। পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। এটাই বড় সফলতা। ব্যর্থতা কিছু থাকবেই। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার কারণে হয়তো বিনিয়োগ যা আসার কথা ছিল তা আসেনি। তবে নতুন বিনিয়োগের সব পথই এখন খোলা। কয়েক মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আমি বলতে চাই, অর্থনীতির বাস্তব চিত্র এখন আপনারা পাচ্ছেন।
বর্তমান সরকার দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নে কতটা সফল—এর উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আমার দেশকে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব ছিল, আমরা সেটি করতে পেরেছি। এখন আর অর্থপাচারের সুযোগ নেই। ব্যাংক লুটের পথ বন্ধ হয়েছে। বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে আমরা মূল্যস্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে পেরেছি। আগের সরকার আমদানি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ সব ডলার পাচার হয়ে রিজার্ভ ছিল তলানিতে। এখন সে সংকট নেই, বরং আমরা এখন মূল্য ধরে রাখতে ডলার কিনছি। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার আগে সবাই বলেছিল এ মুদ্রার দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে শঙ্কা তো নেই-ই, উল্টো রিজার্ভের হিসাব সঠিক পদ্ধতিতে আনার পরও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যথেষ্ট মজুত আছে। ব্যাংকগুলো এখন নিজেই চলতে পারছে। এটাই তো আমাদের সফলতা।
ব্যর্থতার কথা জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, আমরা এখনো ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারিনি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়নি। এটার কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। তবে সেটি চলতি বছর শেষেই কেটে যাবে।
কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বড় কোনো সংস্কার ছাড়াই এ সরকার সফল হয়েছে। যেমন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শূন্য থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতেও সফল হয়েছে সরকার। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের (সিএসপিএস) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান আমার দেশকে বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ হাতে নেয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের এখন সুসম্পর্ক। আমরা কৌশলগতভাবে আর্থিক খাতকে গুরুত্ব দিয়ে যেমন রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করতে সফল, তেমনই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকারের নানা উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপ নিয়ে বাংলাদেশের মতো সফলতা পৃথিবীর অনেক দেশেরই নেই।
সেই সঙ্গে গোটা আর্থিক খাত এখন স্বনির্ভর বলে মনে করেন এই গবেষক ও অর্থনীতিবিদ। তবে রাজস্ব আদায়ে শ্লথ গতি এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরিতে কিছুটা বাধা এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আর্থিক খাতকে পেছনে টেনে নিতে রাজস্ব কর্মকর্তারা টানা কয়েক মাস আন্দোলন করেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়ে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ আসছে না বড় একটি রাজনৈতিক দলের অসহযোগিতা ও তাদের কর্মীদের বিশৃঙ্খলার কারণে। এর বাইরে আর কোনো রড় ব্যর্থতা আর্থিক খাতে নেই।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হারে স্থিতিশীলতা, রিজার্ভ বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ ভারসাম্যে ইতিবাচক অবস্থা, নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতি এবং বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা—আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার ফসল।
তবে পুঁজিবাজার নিয়ে কিছুটা হতাশ বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে শেয়ারবাজার নানা বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের মধ্যে ছিল। এখন সে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খল অবস্থা নেই। কিন্তু বিএসইসি পুঁজিবাজার সংস্কারে যে টাস্কফোর্স করেছে, এটার দারকার ছিল না। বরং বিএসইসি নিজেই এ ধরনের কাজ করতে পারত। এতে এক বছরের মতো সময় নষ্ট হয়েছে। তবে দেশের সার্বিক অর্থনীতি যেহেতু ইতিবাচক ধারায়, তাই শেয়ারবাজারও শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে—সে আশা করি।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, আর্থিক খাত সংস্কারে বর্তমান সরকার দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর একটি ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালায় পরিবর্তন। আগে ৬ থেকে ৯ মাসে ঋণখেলাপি হতো, এখন তা তিন মাসে হচ্ছে। এতে ব্যাংক তাদের দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্ট হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অবস্থান নিরূপণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ছয়টি ব্যাংকে অডিট করা হয়েছে। এসব হলো অগ্রগতি। তবে দুর্বল ইসলামী ব্যাংকগুলো একীভূত করার কাজটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সংকটেও রপ্তানি আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি
হাসিনার পলায়নের পর বড় শঙ্কা দেখা দিয়েছিল রপ্তানি খাতে। এ সময় পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের উসকে দিয়ে শ্রম অসন্তোষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সরকারের কয়েক মাস কেটেছে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিক অসন্তোষ রোধে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপ নিয়েও উদ্বেগ ছিল। তবে পরিসংখ্যান বলছে, রপ্তানি খাত সব শঙ্কা কাটিয়ে অর্থনীতি সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
সদ্য শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৭৭ কোটি পাঁচ লাখ ডলার। এটি আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। ইপিবির প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাইয়ে তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে আয় হয়েছে ৩৯৬ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের একই সময়ে এ আয় ছিল ৩১৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। এ সময়ে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরে এ আয় ছিল ৪৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রেমিট্যান্স আয়ে রেকর্ড
হাসিনার পতনের আগে থেকেই প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধের ঘোষণা দেন। স্বৈরাচারের পতনের পর দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা এখনো চলমান। এর ফলে ইউনূস সরকারের কয়েক মাসের মাথায় ডলার সংকট কাটতে শুরু করে। সবশেষ গত জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আয়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। মূলত রপ্তানি আয় আর রেমিট্যান্স আয়ই এ সরকারের অর্থনীতির চালিকাশক্তি সচলের মূল ভিত্তি।
জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। গত বছরের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে হুন্ডি ব্যবসা করা হতো। এতে বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় কম আসত। তবে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ব্যাংকঋণ বন্ধ হয়েছে। এতে হুন্ডির ব্যবসা কমে গেছে। তাই বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসে তিন হাজার ৩২ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরে এসেছিল দুই হাজার ৩৯১ কোটি ডলার। সে হিসাবে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের প্রবাসী আয় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এক অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স কখনোই আসেনি।
ঋণ শোধে সফল সরকার
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি হাসিনা যখন ক্ষমতায় ফিরে আসেন তখন বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে জাতির ওপর বিদেশি ঋণের বিশাল এক বোঝা চাপিয়ে যায় হাসিনা সরকার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা রেখে যান তিনি।
বিপুল এই ঋণ এখন শোধ করছে ইউনূস সরকার। সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৪০৮ কোটি ৬৯ লাখ বা ৪ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার, যা দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত সরকারের অতিউৎসাহে নেওয়া অনেক বড় প্রকল্পের পেছনে যথাযথ পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক লাভ যাচাই করা হয়নি।
এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে সরকার যেসব বড় প্রকল্পে ঋণ নিয়েছে, তার অনেকগুলোই অতিরিক্ত বাজেট দেখিয়ে তৈরি হয়। ওই প্রকল্পগুলো বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়েই অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে দেশে রাজস্ব আদায় দুর্বল থাকায় বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ে এবং গত সাত বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়।
ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকার নতুন ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী নয়; বরং আগে পুরোনো ঋণ শোধে বেশি মনোযোগী।
বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্ত
রেকর্ড রেমিট্যান্স আয় ও রপ্তানির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিওপিতে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত হয়েছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৯২৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত ২৪ জুলাই শেষে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে ছিল। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী যা ছিল প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, গত তিন বছরজুড়ে ডলারের যে সংকট ছিল, সেটি এই মুহূর্তে পুরোপুরি কেটে গেছে। ব্যবসায়ীরা স্বাচ্ছন্দ্যে আমদানির এলসি খুলতে পারছেন। ডলারের বিনিময়হারও পুরোপুরি স্থিতিশীল। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এসবের ফলে গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের সবকটি সূচকে দৃশ্যমান উন্নতি দেখা গেছে।
মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি
অথনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার ব্যাপকভাবে সফল। বাজারে মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী জুন মাসে সামান্য কমার পর জুলাইয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবারও কিছুটা বেড়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাইয়ে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। জুনে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। জুনে মূল্যস্ফীতির হার বিগত ২৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। এর আগে এপ্রিলে এ হার ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং মে মাসে ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ। জুলাই শেষে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৬ শতাংশের মধ্যে আসবে।
আমানত বাড়ছে ব্যাংকে
হাসিনার আমলে ব্যাংক খাতে বিভিন্ন অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সামনে আসে। এতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ফলে সেসব ব্যাংক থেকে টাকা তোলার চাপ ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সে প্রবণতা কমতে থাকে এবং হাতে রাখা টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ হিসাবে গত মে মাস শেষে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ১৮ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা (আন্তঃব্যাংকসহ), যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। আর ঋণ ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৭২ কোটি টাকায়। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর এডিআর নির্ধারিত সীমার অনেক বেশি হয়েছে।
বিনিয়োগ মন্দা কাটিয়ে ওঠার আশা
বর্তমান সরকারের প্রথম ছয় মাসে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ খুব একটা বাড়েনি। তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৭৬ শতাংশ বেড়েছে আর বছরের ব্যবধানে নিট এফডিআই বেড়েছে ১১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ৮৬৫ মিলিয়ন ডলার। তার আগের তিন মাসে অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে এসেছিল ৪৯০ মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে তিন মাসে নিট এফডিআই বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৪০৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তা বেড়েছে ১১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বিদেশিরা মূলধন (ইক্যুইটি) হিসাবে ২৬৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। এটি তার আগের তিন মাসের তুলনায় ১০০ শতাংশ বেশি। আর বছরের ব্যবধানে ১১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। তবে তিন মাসে বিদেশিদের পুনঃবিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে ৪০ দশমিক ২৩ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে তা কমেছে ২৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বেড়েছে মাথাপিছু আয়
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৮২০ মার্কিন ডলার। বর্তমান সরকারের আমলের এই মাথাপিছু আয় এযাবৎকালের রেকর্ড। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে বিবিএস এ তথ্য দিয়েছে। গত অর্থবছরের চেয়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৮২ ডলার। গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২৭৩৮ ডলার।
কমেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি
জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল হাসিনার সরকার। ভুয়া তথ্য দিয়ে জিডিপিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। বর্তমান সরকার সে পথ বাদ দিয়ে প্রকৃত তথ্যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে। বিবিএস প্রকাশিত সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। আগের অর্থবছরের চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির গতি খানিকটা কমেছে।
চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা অর্থনীতির সামগ্রিক গতিকে তেমনভাবে এগিয়ে নিতে পারেনি। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্থিক খাতে পুরোপুরি গতি ফিরে আসতে হয়তো আরো কয়েক মাস লাগবে। তবে বর্তমান ধারাবাহিকতা থাকলে পুঁজিবাজারে যেমন গতি ফিরে আসবে, তেমনি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে কর্মসংস্থান বাড়বে। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে সংস্কারকাজ শেষ হলে গতি বাড়বে অর্থনীতির। বর্তমানে ঋণের সুদহার প্রায় ১৬ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেহেতু মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী, তাই এখনই ব্যাংকঋণে সুদহার কমিয়ে আনা উচিত। এতে শিল্পে বিনিয়োগ আরো বাড়বে।