Image description

Mishuk Najib

কোনও শাসক গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার পর ক্ষমতার মসনদে ফেরার ইতিহাস এখন পর্যন্ত নেই। ইতিহাসে আজ অবদি অন্তত ৪৮জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে ছিল স্বৈরাচারী শাসন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ।

তবে দণ্ডপ্রাপ্ত সবার রায় কার্যকর হয়নি। বিভিন্ন পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ৩৫ জনের। বাকিদের মধ্যে কেউ রায় ঘোষণার আগে দেশ থেকে পালিয়েছেন। কারও ক্ষেত্রে আবার আপিলে শাস্তি কমেছে।

যেহেতু, সবে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতির, তাই দলের সমর্থকরাও হয়তো আশা করছেন, তাদের নেতা ফিরবেন। ফিরে বিরোধীদের 'শায়েস্তা' করবেন কড়াভাবে। 

এই সমর্থকদের বেশিরভাগই হয়তো ইতিহাস ঠিকঠাক পাঠ করেনি। তাই বোধহয় তারা বিশ্বাস করছেন যে শেখ হাসিনা যেকোনো সময় ‘টুপ’ করে ঢুকে পড়বেন।


দেশের রাজনীতিতে স্বৈরশাসক এরশাদ টিকে ছিলেন, শেখ হাসিনার কী হবে?

বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও শেখ হাসিনা। পতনের পর এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টিকে দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে দেখা গেছে। ক্ষমতার অংশীদারও হয় দলটি। তবে বিভিন্ন ভূমিকার কারণে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।

২০০৬-এর ডিসেম্বরে ঢাকায় ১৪ দলীয় বিরোধী জোট আয়োজিত সমাবেশে কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা (ডান থেকে তৃতীয়) এবং সাথে প্রাক্তন দুই রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (বামে) ও এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (ডানে)। ছবি: এএফপি।


মূলত ক্ষমতায় যেতে জাতীয় পার্টিকে নিজেদের বলয়ে টানার চেষ্টা করতে দেখা যায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। তবে বরাবরই নৌকার দিকেই ঝুঁকেছিল লাঙল। ধানের শীষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ‘এই আছে এই নেই’ টাইপ ছিল। আর আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরে শাসনামলে এমনভাবে জুড়ে ছিল যে, ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ বলেও অনেকে হাস্যরস করেছেন। স্বভাবতই ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী সহযোগী হিসেবে দলটি এখন বেকায়দায়। রাজনৈতিক ভবিষ্যতও নিভু নিভু।

নব্বইয়ে পতনের পর জেলে গেলেও সেখান থেকে ভোটে অংশ নিয়ে জয় পান এরশাদ। তার দল জাতীয় পার্টি সেবার ৩৫টি আসনে জিতেছিল।

এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মোট ৪৩টি মামলা হয়। এর তিনটিতে নিম্ন আদালতে তার সাজার আদেশ হলেও হাইকোর্টে একটিতে খালাস পান। বাকি দুই মামলায় তিনি সাজা খাটা শেষ করেন। আর সেনাবাহিনীর মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলা ছাড়া বাকি সব মামলায় এরশাদ একে একে মুক্ত হয়েছিলেন।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এরশাদের গলার কাঁটা হয়ে ছিল সেই মঞ্জু হত্যা মামলা। জোট আর ভোটের রাজনীতিতে এরশাদকে ‘বশে রাখতে’ এ মামলাটিকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল জাতীয় পার্টির নেতাদের।

অন্যদিকে, এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫৮৬টি মামলা। এর মধ্যে ৩২৪টি হত্যা মামলা, দুদকের মামলা ৬টি। ইতোমধ্যে একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এসেছে তার বিরুদ্ধে।

এরশাদের মতো হাসিনার নামের পাশে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসকের তকমা জুটলেও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ওঠেনি। পতনের পর দেশ ছেড়েও যাননি। জেলে গিয়ে মামলা মোকাবেলা করেছেন আইনিভাবে। যদিও এইসব প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে ‘প্রশ্ন’।

শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। চব্বিশের আন্দোলনের সময় তার বিরুদ্ধে হাজার মানুষ হত্যার অভিযোগ। মানুষ চোখের সামনেই এইসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলোর ডিজিটাল ডকুমেন্টও রয়েছে। তার আগে তো গুম-খুনসহ নানা অভিযোগ রয়েছেই। একটি প্রজন্ম দীর্ঘ সময় ভোট দিতে পারেননি। তারা শেখ হাসিনার দুঃশাসন দেখেছে। শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফিরতে বড় বাধা তারা, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আর শেখ হাসিনা কেবল নিজে পালিয়ে যাননি, তার দলের শীর্ষ বেশিরভাগ নেতাই পালিয়েছেন বিদেশে। তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি-হত্যার অভিযোগ। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ক্লিন ইমেজের কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যিনি দলের হাল ধরতে পারবেন। যার ওপর ভর করে শেখ হাসিনা অন্তত রাজনীতির মাঠে তার দলের সক্রিয় হওয়া নিয়ে আশস্ত হতে পারবেন।

শেখ হাসিনার ফেরা নিয়ে গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এর উত্তর নির্ভর করবে সামনের দিনগুলোতে কারা আসবে এবং তারা কী কাজ করবে।

তার মতে, ‘তারা যদি হাসিনার চেয়ে খারাপ কাজ করে বা হাসিনার মতোই করে, তাহলে হাসিনার ফেরার একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে।’

তবে তার বয়স, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মিলিয়ে এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করছি। এটি ঘটলে ইতিহাস বদলে দেবেন দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা।


আওয়ামী লীগ কি আদৌ ফিরতে পারবে?

যেদিন শেখ হাসিনার রায় হয়, সেদিন বিবিসি ‘শেখ হাসিনা: গণতন্ত্রপন্থী থেকে স্বৈরাচার’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলেছিল, রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফেরা, এমনকি নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ফেরার সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে মেট্রোরেলের খুঁটিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঘৃণাস্তম্ভ, যেখানে আঁকা হয়েছে শেখ হাসিনার ব্যঙ্গ গ্রাফিতি।

 

খুব অন্ধবিশ্বাসী না হলে যে কেউ স্বীকার করবেন যে, এই রায়ের পর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যতে বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। তার দল কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ আরও চাপে পড়েছে।

সংসদ ভবনের সাবজেল থেকে সবুজ মাঠ পেরিয়ে গণভবনে গিয়ে টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নানা গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সেগুলোতে কর্ণপাত না করে ছুটে চলা শেখ হাসিনা নিজের ভাগ্য যেমন ‘লকড’ করে ফেলেছিলেন, তেমনি দলের ভবিষ্যতকেও নিয়ে গেছেন অনিশ্চিত গন্তব্যে। তার পতনে দলও হতবিহ্বল।

এত অস্বস্তির মাঝেও আওয়ামী লীগ হয়তো কিছুটা স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করছে জামায়াতের দিকে তাকিয়ে। কারণ, একাত্তরে গণহত্যার দায় নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করে যাচ্ছে দলটি। চব্বিশের পর বরং দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথেই করছে। একাত্তরের ঐতিহাসিক যে দায় মেটানোর সুযোগ ছিল লাল-সবুজের বাংলায়, সেটি হয়নি। বরং এই অভিযোগটিকে তারা ‘রাজনৈতিক’ বলে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগও তাদের ক্ষেত্রে একই পন্থা শুরু করেছে।

চব্বিশের জুলাইয়ের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সম্ভাবনা ‘মুছে’ ফেলার সুযোগ ছিল। তবে সেই ট্রেন মিস করেছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী দলগুলো। 

এই দুঃসময়েও আওয়ামী লীগের অন্তত ২৫ শতাংশ সমর্থক রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। যদিও ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা প্রায় ১৯ শতাংশ এবং যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

দলটির সমর্থক, বিভিন্ন স্তরে ক্লিন ইমেজের নেতা ও পেশাজীবী সমর্থক এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ নেই— তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা ছিল ‘অদূরদর্শিতা’। অন্তত যারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেখতে চায় না তাদের জন্য। বরং সবার ক্ষেত্রে উল্টো ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়। পাশাপাশি তৃণমূলে ‘নিরাপরাধ’ আওয়ামী লীগ সমর্থককেও ‘হয়রানির’ অভিযোগ তো রয়েছেই।

এছাড়া, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররাও চমক দেখাতে পারেনি। ৫ আগস্টের পরে তাদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুতই অভিযোগ আসতে শুরু করে। রাজনীতিতে নেমে ম্লান হয়েছে তাদের আলো। তারা বিকল্প শক্তি হয়ে দাঁড়াতে না পারায় পতিত শক্তি যে ফিরে আসবে না, তা শক্তভাবে বলা যায় না।

অভ্যুত্থান কিংবা এই ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্বের সামনের সারিতে থেকে এত দ্রুত আবেদন হারিয়ে ফেলার উদাহারণ বোধহয় এ দেশেই একমাত্র পাওয়া যাবে।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ান, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আর একাত্তরকে সমান করে দেখার যে চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে তা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী অনেককেই আঘাত করেছে। তার মানে বলছি না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘বিক্রি’ করা যাবে, যেভাবে জুলাইকে ‘বিক্রির’ অভিযোগও আসছে। কোনও কিছুকে আর নিজের দাবি করে চলা যাবে না যেমন, তেমনি এর ঐতিহাসিক দায় না মিটিয়ে ছোট বা বড় করার চেষ্টা ইতিবাচক ফল আনবে না।

বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ কথা নয়, কাজ দেখতে চায়। পাশাপাশি চায় ইতিহাসকে সমান গুরুত্ব দিতে। তাই কোনও কিছুকে বড় বা ছোট করার রাজনীতি ফল দেবে না ভবিষ্যতে।

শেষ করা যাক, দুটি কথা বলে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ আমলে যেমন অনিয়ম-দুর্নীতি-বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো অভিযোগ ছিল, এ সরকারের আমলেও একই ধরনের অভিযোগ আসছে। আগে হতো গুম করে হত্যা, এখন মব করে। হয়তো মোড়কটা একটু পাল্টেছে। ভবিষ্যতেও এমন ধারা অব্যাহত থাকলে এর সুযোগ যে আওয়ামী লীগ পাবে না, তা কে-ই বা জানে।

দ্বিতীয়ত, স্থানীয় নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ মাঠ পর্যায়ে কিছুটা শক্তি পেতে পারে, এখনই কান পাতলে শোনা যায় এমন। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আসনভিত্তিক হিসেবে নৌকার সমর্থক ও নেতাদের সাথে আঁতাত করছে বিভিন্ন দলের নেতারা। স্থানীয় নির্বাচন দিলে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী, সারাদেশে এটি যে প্রকাশ্যে ঘটবে, তা অনুমেয়।

জামায়াত ও এনসিপির দাবি অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা শক্তি পেতো। যা প্রভাব ফেলতো জাতীয় নির্বাচনেও। 

এ ধরনের পরিস্থিতি বা কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে শক্তি পেলেও দলটিকে পুরনো রূপে (ক্ষমতায় যাওয়ার অর্থে) ফিরতে যে অপেক্ষা করতে হবে, তা নিয়ে বোধহয় সংশয় নেই কারও। অপেক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন সংশোধনও। জনগণের কাছে তাদের ফিরতে হবে খোলস বদলে নতুন রাজনীতি নিয়ে। এখনও প্রতিবেশি দেশের মিডিয়া বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যেভাবে বিষ ছড়াচ্ছেন তারা, তা তাদের ফেরার পথে কাঁটাই বিছিয়ে দিচ্ছে, ফুল নয়।

দলগুলোকে মনে রাখতে হবে— বাংলা প্রতিবাদের ভূমি, এক দূর্ভেদ্য দুর্গ। এই ভূমি বসন্তে ফুল ফোটায় আর গ্রীষ্মে পোড়ায়। 


লেখক: সাংবাদিক