
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয় কাউকে কাউকে আনন্দিত করেছে, কাউকে শঙ্কিত বা চিন্তিত করেছে। তবে প্রায় সবাইকে অবাক করেছে। অবাক হওয়ারই কথা। কারণ, কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ছাত্র সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় দিতে পারত না, তাদের এ ধরনের জয় বিস্মিত করার মতো ব্যাপার বৈকি।
এই ফল দেখে কিছু মানুষ এ কারণে খুশি যে কয়েক দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দলের একচেটিয়া আধিপত্য শেষ হয়ে গেল। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, ছাত্রশিবিরের এ জয়ে অনেকে কেন শঙ্কিত বা চিন্তিত?
সম্ভবত এর প্রধান কারণ ছাত্রশিবির জামায়াতে ইসলামীর একটি অঙ্গসংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জামায়াত একটি প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক দল। ১৯৭১ সালে তাঁরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেই ছিল না, দলটি ছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সমর্থনপুষ্ট। দলটি কেবল মৌখিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়নি, ইতিহাস বলে, তারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে গণহত্যায় সহায়তা করেছিল।
এ কারণে তাদের বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিবর্জিত করা একটি স্বাধীন দেশের পক্ষে খুব স্বাভাবিক ছিল। তাই এ দেশে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতার পর অন্তত প্রথম কয়েক বছর রাজনীতি করতে পারেনি। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর পটপরিবর্তন হতে শুরু করে। কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভাব সেই পরিবর্তনকে আরও বেগবান করে।
মূলত জিয়াউর রহমান নতুন দল সৃষ্টির জন্য একটি বিরাট জাল ফেলেছিলেন এবং সেই দলে সব মতের লোকদের অন্তর্ভুক্তি এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিল। তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাঁর নতুন দলে এমন ব্যক্তিদের এনেছিলেন, যাঁরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের সাফাই গাওয়ার জন্য। এই আজিজুর রহমানকে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানান।
জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে প্রবেশ করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি না দিলেও জিয়াউর রহমান দলটির অঘোষিত প্রধান গোলাম আজমকে পাকিস্তান থেকে আসার অনুমতি দেন ১৯৮০ সালে। তখন থেকেই জামায়াতে ইসলামী পুনর্বাসিত হতে থাকে। এরপর দলটি শুধু চাঙা হয়নি, তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরও পুনর্জীবিত হয়। সুতরাং আজকে যাঁরা ডাকসুতে শিবিরের জয়ের কথা শুনে অবাক হন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, শিবিরের এ জয় রাতারাতি ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়; এটি তাদের চার দশকের পরিশ্রমের ফল।
শিবিরের জয়ে যাঁরা আনন্দিত, তাঁদের সবাই যে জামায়াতের সমর্থক, তা নয়। তাঁদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে একটা মৌলিক পরিবর্তন আসায় আনন্দিত। এখন আবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সদ্য সমাপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে (জাকসু) শিবির-সমর্থক ছাত্রদের জয়।
এখন প্রশ্ন হলো, ডাকসু ও জাকসুতে জামায়াত-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের জয় কি আগামী সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে? জামায়াতে ইসলামী কি এত দিন প্রকাশ্য রাজনীতির বাইরে থেকে জনমনে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে মানুষ তাদের বেছে নেবে?
আগেই বলেছি, ১৯৭৯ সালে গোলাম আজমের দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে জামায়াতের পুনর্বাসন শুরু হয়। ১৯৭২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে দলটি রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকলেও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো নীরবে কাজ করে যেত বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়।
১৯৭৯ সালে জামায়াত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা দিয়ে কাজ শুরু করে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা এগিয়ে আসত বিভিন্ন জেলায়। মোটকথা, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় না হলেও তারা সামাজিক কাজে ব্যস্ত ছিল। এ সময় দলটি নিজেদের সদস্যসংখ্যা বাড়াতেও চেষ্টা চালাতে থাকে। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের তাদের ছাত্রসংগঠনে নিয়োগ করতে থাকে। আমি নিজে দেখেছি, জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অনেক আগে থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিল।
দলীয় শৃঙ্খলা মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে তাদের যে খ্যাতি ছিল, তা অন্য দলগুলোর ছিল না। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ, আমি প্রথমে বলেছিলাম, ছাত্রশিবিরের ডাকসু ও জাকসুতে সাফল্যের পেছনে একটি ইতিহাস আছে।
শুধু একটি ধর্মীয় আদর্শে দীক্ষিত এবং সৎ নেতা হিসেবে প্রচারিত পরিচয়ে একটি জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়া কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে জয়ী হওয়া আর দেশের সাধারণ নির্বাচনে ৩০০ আসনের অধিকাংশে জয়ী হওয়া এক ব্যাপার নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের জয়ের মধ্যে দেশের সাধারণ নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা দেখাকে অতিকল্পনা বলা যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, ডাকসু-জাকসুতে শিবিরের জয় কি জামায়াতে ইসলামীকে সামনের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী করবে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের দেখতে হবে, জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে অতীতে বাংলাদেশের তথা পূর্ববর্তী পাকিস্তানের রাজনীতিতে কতখানি সাফল্য লাভ করেছিল। নির্মোহ বিচারে বলা যায়, ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আমলে সুবিধা করতে পারেনি।
১৯৭১ সালে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনসাধারণের মনে একটি বৈরি মনোভাবের সৃষ্টি করে। তাদের নেতা গোলাম আজম একাই দলটিকে একটি আলাদা সত্তায় চালান। এতে ফল হয়, তারা নিজস্ব সত্তা নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে যোগ দিতে পারে এবং সুযোগ বুঝে বড় দল যেমন আওয়ামী লীগ বা জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে মাঝেমধ্যে সম্পৃক্ত হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা এটি দেখেছি।
এই সম্পৃক্ততার বিশেষ ফল আসে এরশাদের পতনের পর। ওই সময় সাধারণ নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ১৮টি আসন লাভ করে এবং বিএনপির সঙ্গে জোট সরকার গঠন করে। এটি ছিল জামায়াতের প্রকৃত জয়; যদিও তা পরে টেকেনি।
এরপর আওয়ামী লীগ প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে জামায়াতের বিরুদ্ধে যদিও কঠিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, কিন্তু দ্বিতীয় দফায় তারা জামায়াতকে রাজনীতি থেকে উৎপাটন করার চেষ্টা চালায়। জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা হয়। তাঁদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড, কাউকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মূলত শেখ হাসিনার শাসনকাল (২০০৯-২৪) জামায়াতের জন্য ছিল এক ভয়াবহ সময়।
শেখ হাসিনার শাসনামলে জামায়াত রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত হলেও (এ সময় তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়) তারা তাদের কাজ চালিয়ে গেছে। ছাত্রশিবির কৌশলে অন্য দলে (ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল) অনুপ্রবেশ করে ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করে নিজেদের পরিচয় সৃষ্টি করেছে। এর সুফল তারা পেয়েছে। সে সুফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ছাত্রশিবিরের পরিচয় কি জামায়াতের দেশব্যাপী নির্বাচনে সাহায্য করতে পারবে?
যেকোনো রাজনৈতিক দলের বড় ধরনের নির্বাচনে বিজয় নির্ভর করে তাদের নেতাদের পূর্বপরিচিতি, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতার ওপর। দল হিসেবে জামায়াতে ইসলাম এখনো পরীক্ষিত নয়, যদিও তাদের কয়েকজন প্রায় তিন দশক আগে মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছিলেন, যাঁদের কেউ আজ বেঁচে নেই।
শুধু একটি ধর্মীয় আদর্শে দীক্ষিত এবং সৎ নেতা হিসেবে প্রচারিত পরিচয়ে একটি জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়া কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে জয়ী হওয়া আর দেশের সাধারণ নির্বাচনে ৩০০ আসনের অধিকাংশে জয়ী হওয়া এক ব্যাপার নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের জয়ের মধ্যে দেশের সাধারণ নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা দেখাকে অতিকল্পনা বলা যেতে পারে।
আগামী নির্বাচনে (ধরে নিচ্ছি নির্বাচন সত্যিই হচ্ছে) জামায়াত কতখানি সফলতা পাবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এই মত দিচ্ছেন। জামায়াতে ইসলাম শুধু সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ দল নয়, তারা একটি পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল। তাদের নেতৃত্ব অনেক দায়িত্ববান এবং তারা আগামী নির্বাচনকে কৌশলে সামলাবেন।
তবে আশার কথা, বাংলাদেশের জনগণ আর যা-ই হোক, বাগাড়ম্বর শুনেও তারা কাকে ভোট দেবে, সেটা তারা বোঝে। জাতীয় সংসদের নির্বাচন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন যে এক নয়, সেটা তারা বোঝে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে স্বচ্ছতার জন্য হোক বা ধর্মীয় ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য হোক, জামায়াত এবার নির্বাচনে বেশ ভালো করবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা কিছুতেই পাবে না।
তবে ভবিষ্যৎ জাতীয় সংসদে তারা একটি শক্তিশালী দল হিসেবে ভূমিকা রাখবে। তারা অন্য কোনো দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে সরকার হয়তো গঠন করতে রাজি হবে না, তবে সরকারকে সুশাসন করতে বাধ্য করবে। দলটি এমনভাবে নিজেকে পরিচালিত করবে, যাতে ভবিষ্যতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারা তাদের আদর্শ রাষ্ট্র স্থাপনের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।