‘বাড়ির গেট ভাঙার পর ম্যাডামকে অনেকটা জোর করে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। ভেতরে গিয়ে ভাঙে ম্যাডামের কক্ষের দরজা। এরপর এক কাপড়ে যে গাড়িতে ম্যাডামকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল সেটি চালাচ্ছিলাম আমি।’
নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে বের করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিনের স্মৃতিচারণে মঙ্গলবার সমকালকে এসব কথা বলছিলেন গাড়িচালক নুরুল আমিন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়েছেন। নুরুলের ভাষায়, ‘এক কাপড়ে বের হন ম্যাডাম, আমি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাই।’
সেদিন সেনানিবাসের বাড়ি থেকে সরাসরি গুলশানে দলীয় কার্যালয়ে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। নুরুল আমিন বলেন, ‘গাড়িতে উঠে ম্যাডাম গুলশানের অফিসে যেতে বলেন। ওই গাড়িতে তখন আরও ছিলেন ছোট ভাই শামীম ইস্কানদারের স্ত্রী, বিশেষ সহকারি মাহবুবুল আলম, মাসুদ ও আরিফ নামে পুলিশের একজন গানম্যান। গুলশানে পৌঁছানোর পর গণমাধ্যমের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। সেই দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক।
মঈনুল রোডের বাড়িটি ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তাঁর পরিবারের কাছে আবেগ, ইতিহাস ও স্মৃতির আতুরঘর। ওই বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন তাঁর সন্তানরা। ১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হওয়ার পর মঈনুল রোডের বাড়িটিতে বসবাস শুরু করেন। এরপর সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালেও তিনি বাড়িটিতে থাকতেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর তৎকালীন জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তে বছরে মাত্র এক টাকা খাজনার শর্তে বাড়িটি খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
খালেদা জিয়াকে ঢাকার সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা দেশের রাজনীতিতে এক বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৯ সালের এপ্রিলে তৎকালীন সরকার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাড়িটির ইজারা বাতিল করে। সরকার তখন দাবি করেছিল, ইজারা প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ছিল এবং সেনানিবাস এলাকার নিয়ম অনুযায়ী বাড়িটি রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়া ছিল নিয়মবহির্ভূত। ওই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই উচ্ছেদ-সংক্রান্ত নোটিশ জারি হয়। তবে অনেকে মনে করেন, খালেদা জিয়াকে বাড়ি উচ্ছেদ করার পেছনে ছিল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রোশ।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০০১ সালে শেখ হাসিনা আইন করে নিজের জন্য গণভবন বরাদ্দ নিয়েছিলেন। একই সময় তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কে এক বিঘার একটি সরকারি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। আজীবন তাদের জন্য এসএসএফ’র নিরাপত্তা, পৃথক আবাসন বরাদ্দ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয় আইনে।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি। এরপর শেখ হাসিনা ও রেহানার জন্য ভবন বরাদ্দ বাতিল করা হয়। খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পেছনে এমন পদক্ষেপের ভূমিকা ছিল বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। ভোট বর্জন করে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন চালায়। ওই নির্বাচনের আগে (২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর) ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তখন বালুর ট্রাকের বেষ্টনী দিয়ে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন ফিরোজার ফটক অবরুদ্ধ করে রেখেছিল পুলিশ। এই বাধার কারণে নিজ বাসভবন থেকেও তখন বের হতে পারেননি খালেদা জিয়া।
নুরুল আমিন বলেন, দুদকের মামলায় খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরও ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি গাড়িচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ২০২১ সালে করোনার সময় অসুস্থ হলে নিজে গাড়ি চালিয়ে খালেদা জিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে।