Image description

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংসারে নিতান্ত এক সাধারণ গৃহবধূ থেকে উঠে এসেছিলেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। তার মৃত্যুতে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

বেগম খালেদা জিয়া খুব অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। সংসার দীর্ঘ না হলেও তাদের পরবর্তী জীবনের মতো বিয়ে পর্বটাও ছিল রূপকথার মত। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কলেজে পড়ার সময়ই নানার মুখে শুনেছিলেন খালেদা, সবার আদরের পুতুলের সৌন্দর্য্যের কথা। মকবুল নানা বলেছিলেন, ‘ওকে অন্ধকার রাতে দেখলে মনে হবে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।’ একই কথা বলেছিলেন ছবি মামাও। রূপমুগ্ধ জিয়া তখন থেকেই দূর সম্পর্কের এই খালাত বোনকে দেখার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ পাওয়া মাত্র দেখেই নানা আর মামার বক্তব্যের সত্যতা পান তিনি। উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর সৌন্দর্য্যে বিমোহিত জিয়া মনের মনিকোঠায় স্বপ্ন বুনতে থাকেন পুতুলকে নিয়ে।

জিয়াউর রহমান আর খালেদা জিয়ার বিবাহ ও সংসারের এসব খুঁটিনাটি উঠে এসেছে মা আর ভাই-বোনেদের স্মৃতিতে। সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবদাল আহমেদ তার ‘নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া: সংগ্রামমুখর জীবনের আলেখ্য’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন তাদের বক্তব্য। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য গ্রন্থটির ‘সংসার জীবনে’ অধ্যায় থেকে থেকে মা ও ভাই-বোনদের চোখে বেগম খালেদা জিয়ার বিয়ে ও সংসারের টুকরো চিত্র তুলে ধরা হল।

খালেদা জিয়ার বিয়ের ঘটনা বর্ণনা করে তাঁর বড় বোন খুরশীদ জাহান বলেন— জিয়া তখন ছিল সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআই’র (ডিরেক্টরেট অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, বর্তমান ডিজিএফআই) অফিসার হিসাবে ওর পোস্টিং হল দিনাজপুরে। আমরা থাকতাম দিনাজপুরের ঈদগাঁ বস্তি এলাকায় ভাড়া বাসায়। দিনাজপুরে চাকরির সময় জিয়া মাঝে-মধ্যে আমাদের বাসায় আসত। জিয়ার একটা অসম্ভব গুণ ছিল, সে সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারত। পুতুল ম্যাট্রিক পাস করার পর জিয়া একদিন আমাদের বাসায় এলো। আম্মার কাছে গিয়ে বলল, ‘খালা আমি আপনার জামাই হতে চাই । আম্মা হেসে ফেললেন। তখনই কিছু বললেন না। আব্বা বাসায় এলে তাকে বলা হল জিয়ার কথা। আব্বা বললেন, মন্দ কি! তবে পুতুলের বয়স তো খুব কম। আম্মা এ ঘটনাটি আমার স্বামীকে (মোজাম্মেল হক) জানালেন। তিনি সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ তার যুক্তি ছিল পুতুলের বয়স খুব কম। মাত্র স্কুলে পড়ছে। ডিগ্রি পাস না করা পর্যন্ত বিয়ে হয় কী করে। অন্যদিকে জিয়া সেনাবাহিনীর লোক। এটা নিয়েও আমরা ভাবলাম। প্রথমে প্রায় সবারই অমত ছিল। তবে জিয়াকে আমরা সবাই পছন্দ করতাম। এদিকে জিয়াও বার বার খবর নিতে থাকল। অবশেষে আমরা বিয়েতে সম্মত হই।

খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার জানান, তার মকবুল চাচা (জিয়ার নানা) আনুষ্ঠানিকভাবে জিয়ার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে মুদিপাড়ার বাসায় জিয়া ও খালেদার বিয়ে হয়। বিয়ে হয়েছিল অনেকটা তাড়াহুড়ো করে। প্রথমে আকদ হয়েছিল। এক বছর পর ঢাকার শাহবাগ হোটেলে (বর্তমান পিজি হাসপাতাল) তাদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দরের এখনো মনে আছে সেই বিয়ের স্মৃতি। তিনি বলেন —

ছোট আপার বিয়েতে আমরা তেমন জাঁকজমক অনুষ্ঠান করিনি। খুব ইনফরমাল বিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ শুধু আকদ। অবশ্য গায়ে হলুদ হয়েছে। ছোট আপার হাতে মেহেদি রাঙানো হয়েছে। হলুদ শাড়ি পরানো হয়েছে। বিয়েতে জিয়ার ছবি মামা, মকবুল নানাসহ কয়েকজন নিকট-আত্মীয় এসেছিলেন। জিয়ার সঙ্গে তাঁর সহকর্মী একজন পাঞ্জাবি অফিসারও বিয়েতে এসেছিলেন। জিয়ার বাবা মনসুর রহমান তখন পাকিস্তানে ছিলেন। মা রাণী বিয়ের আগেই ইন্তেকাল করেছেন। এক বছর পর ঢাকায় শাহবাগ হোটেলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আত্মীয়স্বজন অনেকেই এসেছিলেন।

 

বিয়ের স্মৃতি বর্ণনা করে মেজো বোন সেলিমা ইসলাম বিউটি বলেন—

১৯৬০ সালে আমার বিয়ের কয়েক মাস পরে আগস্ট মাসে পুতুলের বিয়ে ঠিক হয়। আম্মা হঠাৎ খবর দেন যে, তোমরা একটু আস। বিয়েতে আড়ম্বর হয়নি। আমিই পুতুলকে গায়ে হলুদ দিয়েছি এবং মেহেদি মেখে দিয়েছি। জিয়ার সঙ্গে ওকে বেশ মানিয়েছিল।

বিয়ের পর জিয়া অবসর পেলেই খালেদা জিয়াকে নিয়ে বেড়াতেন। একবার তারা বড় বোন খুরশীদ জাহানের খুলনার খালিশপুরের বাসায় বেড়াতে যান। খুরশীদ জাহানের স্বামী মোজাম্মেল হক খালিশপুর নিউজপ্রিন্ট মিলের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সেই স্মৃতিও মনে আছে খুরশীদ জাহানের—

বিয়ের পর পরই ওরা আমাদের বাসায় এসেছিল। এখানে বেশ কয়েকদিন ছিল। এমন চমৎকার দম্পতি আমি দেখিনি। আমার বোন বলেই নয়। আসলে দুজনেরই একই গুণাবলি ছিল। একজন আরেকজনকে অসম্ভব ভালোবাসত। নতুন জামাই হিসাবে জিয়াকে আমার মনে হয়নি। পুতুলকে নিয়ে জিয়া আমার রান্নাঘরে এসে বসত। বলত বড় আপা ওটা খাব, এটা খাব। বলত বড় আপা আমার জন্য সেমাই রাধছেন! সেমাই ঠাণ্ডায় রেখে দিন। ঠাণ্ডা খেতে ভালো লাগে। আবার দেখতাম বলত বড় আপা মাংস রাঁধছেন? দেন তো এক টুকরো মাংস? পুতুলকে দেখতাম লজ্জায় মরে যাচ্ছে। জিয়ার ওইসব ঘটনায় পুতুল ওকে ক্ষ্যাপাতো। বিয়ের পর ওরা একবার বাগবাড়ি গ্রামেও গিয়েছিল। বগুড়ার বাগবাড়ি হলো জিয়ার গ্রামের বাড়ি। জিয়ার শৈশবের কিছুদিন ওখানেই কেটেছে।

১৯৬৫ সালে জিয়া খালেদাকে নিয়ে পাকিস্তান চলে যান। চাকরিতে সেখানে তার পোস্টিং হয়। ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানেই ছিলেন। জিয়া যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তিনি ‘খেমকারান’ রণাঙ্গনের ‘বেদীয়ান’-এ যুদ্ধরত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তাঁর কোম্পানির নাম ছিল আলফা কোম্পানি। সে যুদ্ধে জিয়া বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময়ের কথা জানিয়ে বেগম খুরশীদ জাহান বলেন—

ওই সময় পুতুল এবং জিয়ার খবর নেয়ার জন্য আমরা প্রায়ই পাকিস্তানে ফোন করতাম। পুতুল তাদের কুশলাদি জানাত। আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করতাম কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে ছিল দৃঢ় মনের। বলত তোমরা অযথা ভেব না । পাকিস্তানের বান্নো এলাকায় পুতুল থাকত।

পাকিস্তান থেকে ফেরার স্মৃতি বর্ণনা করে মা বেগম তৈয়বা মজুমদার জানান, পুতুল ওর শ্বশুরের খুব প্রশংসা করত। বলতো ওর শ্বশুর ওকে খুব আদর করত। এটা কিনে দিত, ওটা কিনে দিত। ওর শাশুড়ি পাকিস্তান রেডিওতে যে গান করতেন তা বলত। জিয়া ও পুতুল ছিল মধুর দম্পতি। ওরা কেউ কারো সম্পর্কে কোনোদিন অভিযোগ করেনি।