দুইটা গল্প বলবো।
৯৭ সালে আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের একজন ইয়াং লেফটেন্যান্ট। সেই সময়ে আর্মির ইউনিট গুলোতে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়েছে মাত্র। আইটির প্রতি দুর্বার আকর্ষণ থেকে আমি লাইব্রেরির বই পড়ে পড়ে পিসি ট্রাবলশুটিং, এক্সেস প্রোগ্রামিং ও বিভিন্ন অ্যাডভান্সড টেকনোলজিকাল বিষয় শিখে ফেললাম । তখন বিভিন্ন ইউনিট থেকে আমার সিওকে জানিয়ে ,নিয়ে যেত, তাদের টেকনোলজির বিভিন্ন ইস্যুতে সমাধান করতে।
কুমিল্লার মেস বি-তে থাকতাম। আমার মেসের কাছেই ছিল এসএমআই, অর্থাৎ স্কুল অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স। এসএমআই-এর কিছু সিনিয়র অফিসারদের সাথে আমার পরিচয় হয় টেকনোলজির প্রতি ভালোবাসা থেকে। অনেক সিনিয়র হলেও প্রায়ই ছুটির দিনে অনেক সিনিয়র এই অফিসারদের রুমে চলে যেতাম, গিটার বাজাতাম, আড্ডা দিতাম।
আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমরা বিভিন্ন টিপস শেয়ার করতাম, কম্পিউটার ট্রাবেল শুটিং এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম।
স্কুল অফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের অফিসারদের সাথে আলোচনায় আমি একটা খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস জেনেছিলাম, যেটা এখন বলা কোনো গোপন কিছু নয়—বাংলাদেশ আর্মি সেই ৯৭/৯৮ সালে, শেখ হাসিনার শাসনামলেও ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র, রসদ ও ইউনিফর্ম সরবরাহ করতো।
অনেককে অবাক করতে পারে কারন কিন্তু, ফ্যাক্ট হলো বাংলাদেশ আর্মি শেখ হাসিনার আমলেই ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদিদের সাপোর্ট দিয়ে গ্যাছে , এইটা গোপন কোন তথ্য না, ভারতীয় ও বাংলাদেশি ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা সবাই জানে ।
এই প্রতিরোধ, বিএনপির আমলের ১০ ট্রাক অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টা পাবলিক হয়ে ব্লো-আউট করা পর্যন্ত চালু থাকে।
কেউ এখানে বাগাড়ম্বর করতো না।
এইটা ছিল একটা কোয়াইয়েট ডিফায়েন্স, অর্থাৎ নীরব প্রতিরোধ।
এখানে ভারত থেকে সেভেন সিস্টারস আলাদা করার কোনো বিষয় ছিল না।ফিলোসফিটা খুব স্পষ্ট—তোমরা আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আর্মস দিচ্ছো, আমরাও তোমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আর্মস দিচ্ছি।
ভারতীয়রা জানে বাংলাদেশিদের আত্মমর্যাদা অত্যন্ত প্রকট এবং আমরা কখনোই ভারতের বশীভূত হবো না। এই জন্যই তারা শেখ হাসিনা প্রজেক্টের মাধ্যমে একজন লেন্দুপ দরজিকে ঢুকিয়ে বাংলাদেশ শাসন করেছে।
হাসিনার পতনের পর সেই কোয়াইয়েট ডিফায়েন্স এখন সমাজে, রাষ্ট্রে, রাজনীতিতে আবার মূর্তমান। এইটা রাস্তায় রাস্তায় ঘোষণা দেওয়ার কিছু নাই।
রাস্তায় ঘোষণা সেই সব হিটখোর , যাদের দেশের মানুষকে বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা—এমনকি ভারতীয় দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার মতো কোনো পরিকল্পনা আর প্রজেক্ট নাই। তাই তারা দেশের মানুষকে বোকাচোদা বানিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়।
তাই তাদের বলতে হয় , আমাদেরকে হাসিনাকে ফেরায় না দিলে তোমাদের সেভেন সিস্টার বিচ্ছিন্ন করে দিবো।
এইটা আমি বলি বোকাচোদা পল্টিক্স কারন, এই সেভেন সিস্টার আলাদা করে দেবো বয়ানের ধরে নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের মানুষ এতই বোকাচোদা যে মানুষ ধরতে পারবেনা সেই লক্ষ্য পূর্ণ করার সামর্থ্য , ইচ্ছে আর প্রয়োজনীয়তা কোন টাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাই।
তঅ রাজনৈতিক নেতারা কিভাবে মানুষকে বোকাচোদা বানায় , সেইটার জন্য বলি দ্বিতীয় গল্প।
“শাহবাগ থেকে শাপলা” বইটাতে আমি স্পষ্ট দেখিয়েছি কেন শেখ হাসিনাকে শাহবাগ প্রজেক্ট তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে বিভাজন করতে হয়েছে।
২০১১ থেকে আমি নিয়মিত লিখি। প্রতি বছরের শেষে আমি একটা নোট লিখতাম—কেন ২০১২ বা কেন ২০১৩ সালকে আমি ভুলবো না।
৩১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে এসে আমি পুরো ২০১২ সালকে সামারি করি। এই সামারিতে আমি দেখাই,
২০১২ সালের প্রধান ইস্যু ছিল—
হুমায়ুন আহমেদের চলে যাওয়ার
শেয়ার মার্কেটের ধস মেনে নেওয়ার
পদ্মা ব্রিজের সিটকমের এক
রামু অঘটন
ডেসটিনি সহ এমএলএম ব্যবসা ধরা খাওয়া
সরকারি ব্যাংক ধসে পড়া
মানুষের জীবনের মূল্য এক লক্ষ টাকা নির্ধারিত হওয়া
কিন্তু ২০১৩ সালের শেষে আমি যখন ২০১৩ কে সামারি করি সেখানে আমার কাছে প্রধান ঘটনা ছিল
শাহবাগ থেকে শাপলা
ধর্ম বনাম নাস্তিক বিতর্ক
মৌলানা সায়েদির রায়ের পর দেশ ব্যাপি বিক্ষোভে হত্যাকান্ড
হেফাজতের উত্থান
৫ই মে শাপলার জাগরন
কাদের মোল্লার ফাঁসি
হাসিনা-খালেদার ফোনালাপ
আপনি পরিষ্কার দেখতে পারবেন, ২০১২ সালের মানুষের আলোচিত ইস্যু এবং ২০১৩ সালের মানুষের আলোচিত ইস্যু ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
২০১২ সালের বিষয়গুলোতে সব ছিল জনগণের বিষয়ক ইস্যু, যেখানে দলমত নির্বিশেষে দেশের আমজনতা সরকারের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে এসে মানুষের বিষয়গুলো জনসম্মুখ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় এবং হাজির করা হয়, বিভাজনের রাজনীতি ।
এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে —মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, ইসলামি জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের মতাদর্শিক ইস্যু—যাতে বড় একটা অংশ সরকারের পক্ষে থাকে এবং বড় একটা অংশ সরকারের বিপক্ষে । দেশের সম্মিলিত যে বিবেক এবং চাওয়া, তা বিভক্ত হয়ে যায় ।
২০১৩ সালে শেখ হাসিয়ান্র এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশ জাতির মধ্যে একটা আদর্শিক বিভাজন তৈরি করে সরকারের জন্য সেনসিটিভ ইস্যুগুলো সরিয়ে আদরশিক প্রশ্ন গুলোকে পুরো জাতির সামনে প্রধান সমস্যা হিসেবে হাজির করে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ছিল একটা টুল মাত্র যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সফলভাবে ২০১২ সালের বড় জনগণের প্রকৃত ইস্যুগুলো—যেমন দুর্নীতি, ঋণ, শেয়ার মার্কেট, পদ্মা সেতু, হলমার্কের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকগুলো ধ্বংস, ৮,০০০ কোটি টাকা লুট যা বাংলাদেশের জন্মের পর সবচেয়ে বড় লুটের ঘটনা এবং বেসিক ব্যাংক, সোনালী, জনতা মিলে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকার লুট—মানুষের আলোচনা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
ফলে “শাহবাগ থেকে শাপলা” গ্রন্থে আমি যা বলেছি, ২০২৫ সালে এসে একই কথাই বলবো—কোয়াইয়েট ডিফায়েন্সের জায়গায়, ৭ সিস্টার আলাদা করে দিবো এই সব বয়ানের লক্ষ্য হলো সাধারণ মানুষকে বোকাচোদা বানানো, যার লক্ষ্য রাজনীতিবিদের তঞ্চকতাকে আড়াল করা।
আমি শুরু করতে চাই না এনসিপির তিনজন মন্ত্রী বিগত দেড় বছরে দেশকে কী দিয়েছে, তাদের দুর্নীতি, বিকেল তিনটায় অফিসে আসা আর স্বজন প্রীতি আর দুর্নীতি ব্যাতিত ।
আমি সেটা বলবো না, কারণ আমি এখনো এনসিপি প্রস্রয়ের চোখে দেখি। আমি এখনও বিশ্বাস করি ও চাই এনসিপি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় আসুক।
এবং আমি এনসিপির মধ্যে হাসনাতকে সব চেয়ে ভালোবাসি। এনসিপির পুরো পলিটিকাল সেটাপে যাকে আমার প্রচণ্ড পটেনশিয়াল মনে হয়, সে হলো হাসনাত।
ফলে আমি চাই না, হাসনাত পিনাকী-ইলিয়াসের প্রদর্শনবাদি উগ্রতা, আর মাহফুজের সভ্যতাগত রূপান্তরের বালছালের খপ্পরে পড়ুক।
আমি চাই, হাসনাত মধ্যমপন্থী রাজনীতি করুক গণমানুষের নেতা হয়ে উঠুক।
কথা কাজের রেসপনসিবিলিটি শিখুক। শিখুক কোইয়েট ডিফেন্স কী।
একটা শীর্ষ নেতার পাশের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ডাক দেওয়ার অর্থ দেশের মানুষকে আবালচোদা মনে করা।
আমি হাসনাতকে জানাইতে চাই এই দেশের মানুষ আবাল না, তারা এই সব হিটখোর বয়ানের লক্ষ্য বোঝে।
হাসনাত কি জানে, গত এক মাসে বিএসএফ ১০ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে? আমাদের নতজানু সরকার তার বিরুদ্ধে কিছুই করে নাই। আমাদের চিকেন নেকের পাশে ভারত এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করেছে। তারা এখন চিকেন নেক দখলের অপারেশনাল প্ল্যান করেছে, যেগুলো আগে ছিল না।
ফলে যেটা হাসনাতের কাছে রেটোরিক, সেইটা ঐ দেশের আরও আবাল ন্যাশনালিস্টরা ফুলিয়ে তুলবে। সেই রেটোরিক এসকেলেট হয়ে কারো কিছু হবে না, বিএসএফের হাতে লাশের পরিমাণই বাড়বে।
হাসনাত কি জানে বাংলাদেশ আর্মি ডিফেন্সিভ আর্মি, অফেন্সিভ আর্মি না? একটা ডিফেন্সিভ আর্মিকে অফেন্সিভে রূপান্তর করতে যে ব্যয় হবে, সেইটার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে?
হাসনাত কি জানে, বিগত আড়াই বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমা ২০% থেকে ২৯%-এ উঠে গেছে—বিগত ৫ দশকের দ্রুততম অবনমন?
আমাদের সরকারের রাজস্বের প্রায় ৩৬% যাচ্ছে সুদ পরিশোধে।
আমাদের সামনে আর্থিক দুর্যোগ আসছে।
আমাদের কোনো নেতাকে সেভেন সিস্টার বিচ্ছিন্ন করার ডাক দেওয়ার দরকার নাই। এই পিনাকীরা মানুষএক কে বোকাচোদা বানানোর রাজনীতি করতে চায়, কারণ পিনাকীরা দেশে আসবে না। হাসনাত দেশে আছে, গণমানুষের রাজনীতি করছে—তাকে গণমানুষের জন্য মানুষের রাজনীতি করতে হবে, হিটখোরের রাজনীতি না।
একবার হিটখোর হইয়ে গেলে সেই ফাদ থেকে বের হইতে পারবে না, সারা জীবন হিটখোর হয়ে থাকতে হবে, রাজনীতি ও শিখবেনা, নিজেকেও আগাইতে পারবেন না দেশকেও পেছনে নিয়ে চাওয়া বাদে আর সলিউশান দিতে পারবেন না ।
এই প্রজন্মের সবচেয়ে পটেনশিয়াল পলিটিশিয়ান হিসেবে এইটাই আমার হাসনাতের কাছে চাওয়া— ভারত বিরোধী হিটখোর হওয়া খুব সহজ। কিন্তু তার দৌড় আধ মাইল। আসল পলিটিক্স অনেক কঠিন, ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আর মাঠের রিয়ালিটি আলাদা। মানুষের প্রবলেম বুঝেন, মানুষের চাওয়া বুঝেন, মানুষকে মুক্তির পথ দেখান , সাধারণ মানুষকে বোকাচোদা ঠাউর করে হিটখোর হওয়ার ফাঁদে পইরেন না।
সাভিকো ভিজে দিভাস কো সুভ কামনা