Image description

 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় মদদ দেওয়া অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। ঘটনার পর ১৪ মাস কেটে গেলেও বিচারকাজে অগ্রগতি না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একই ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিচার শেষ করে স্থায়ী বহিষ্কার কিংবা কারও সনদ বাতিল করা হলেও অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিচারকাজ নিয়ে প্রশাসন গড়িমসি করছে।
 
অভিযুক্ত ১৯ শিক্ষক কারা
 
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার মদদ দেওয়ার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১৯ শিক্ষককে অভিযুক্ত করে। তাঁরা সবাই অতীতে আওয়ামীপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
 
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকরা হলেন সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, সাবেক প্রক্টর আলমগীর কবির, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ রঙ্গন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী ইকবাল, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডিন বশির আহমেদ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হোসনে আরা, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল হোসেন তালুকদার ও পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার।
এ ছাড়া হামলার ঘটনায় আরও ১০ শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা ও অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা হলেন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের প্রভাষক কানন কুমার সেন, আইবিএর অধ্যাপক পলাশ সাহা, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মোহাম্মদ তারেক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম খোন্দকার, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনির উদ্দিন শিকদার ও অধ্যাপক মোহাম্মদ ছায়েদুর রহমান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার খসরু পারভেজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহিবুর রৌফ শৈবাল এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এ মামুন।
 
তদন্ত ও বিচারকাজে মন্থরগতি

 

গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ নম্বর হলের সামনে এবং উপাচার্যের বাসভবনে কোটা সংস্কারের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও ১৭ জুলাই গুলিবর্ষণের ঘটনায় আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও কমিটি তা জমা দেয় চার মাস পর।
 
এই বিলম্ব প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘৩০ কার্যদিবসে তদন্ত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জমা দিতে চার মাস লেগেছে। বিচার নিয়ে প্রশাসনের সদিচ্ছা নেই বলেই মনে হয়।’
 
জুলাই আন্দোলনের সময় ১৪ জুলাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে, ১৫ জুলাই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু হলের সামনে ও সেদিন রাতে উপাচার্যের বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে ২৮৯ শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করা হয়। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ১৭ মার্চ সিন্ডিকেট সভা থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
 
এ সময় ৯ শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং মোট ১৯ জনের বিরুদ্ধে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়। তবে গঠনের আট মাস পরও এসব কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়েনি। জানা গেছে, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিচারকাজ শেষ হতে পারে।

 

শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

 

২৮৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮৯ জনকে চলতি বছরের ৪ আগস্ট বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কারও আজীবন বহিষ্কার, কারও সনদট বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে।
 
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিচার দ্রুত হয়ে গেল, অথচ যেসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁদের বিচার হচ্ছে না। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলাও আছে, তবু তাঁরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
 
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ফাহমিদা ফাইজা বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষকদের বিচার করেন না। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও অবস্থানগত সুবিধার কারণে শিক্ষক অপরাধে জড়ালেও দিনশেষে দোষী প্রমাণিত হয় শিক্ষার্থীরাই।’
 
সংগঠনগুলোর অভিযোগ
 
ছাত্র-শিক্ষক সংগঠনগুলো বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বিচার; উভয় ক্ষেত্রেই গড়িমসি হচ্ছে। ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি জাহিদুল ইমন বলেন, ‘বিচারকাজে গড়িমসি বরদাস্ত করা হবে না। প্রয়োজনে আন্দোলন করে প্রশাসনকে চেয়ার থেকে নামাতে জানি।’
 
ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দীন মো. বাবর বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা বিচার দাবি করেছি। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বলেছিল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিচার সমানতালে চলবে। কিন্তু এখন দেখছি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ধীরগতি।’
 
চোখে গুলিবিদ্ধ ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও ইউনিভার্সিটি টিচার্স ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক খো. লুৎফুল এলাহী বলেন, ‘শিক্ষকদের বিচার নিয়ে গড়িমসি হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় দুই বিচারই চাই।’

 

প্রশাসনের বক্তব্য
 
প্রশাসন বলছে, গড়িমসি নয়, সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতেই সময় লাগছে।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রব বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে বিচার করতে সময় লাগবেই। আমরা গড়িমসি করছি না।’
 
উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘১৯ শিক্ষক মানে ১৯টি কমিটি। সব সভা একসঙ্গে করা যায় না। আলাদা করে করতে হয়। শিক্ষার্থীদের বিচার আমরা করেছি, শিক্ষকদের বিচারও করব। আগামী বছরের মার্চের মধ্যেই বিচার শেষ করার আশা করছি।’