আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ৮ হাজার ৭৪৬টি ভোটকেন্দ্রকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, ২ হাজার ৬৭৫টি। আর সিলেট বিভাগে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা সবচেয়ে কম। সেখানে এমন কেন্দ্র রয়েছে ৪৫৭টি।
কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোটারসংখ্যা, থানা থেকে ভোটকেন্দ্রের দূরত্ব, কোন এলাকায় কোন রাজনৈতিক দলের আধিপত্য রয়েছে, দুর্গম এলাকা, পাহাড়ি এলাকা ও চরাঞ্চল—এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশের ভোটকেন্দ্রগুলোকে লাল (অতি ঝুঁকিপূর্ণ), হলুদ (ঝুঁকিপূর্ণ) ও সবুজ (সাধারণ) তিন ভাগে ভাগ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ১৬ হাজার ৩৫৯টি। ঝুঁকি নেই এমন ভোটকেন্দ্র (সাধারণ) ১৭ হাজার ৬৫৬টি।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে তিনজন পুলিশ সদস্য, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুজন সদস্য ও সাধারণ কেন্দ্রে একজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা হয়েছে। এর পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের কাছে অস্ত্র এবং ‘বডি ওর্ন ক্যামেরা’ (ভিডিও ক্যামেরা, যা পোশাক বা ইউনিফর্মে যুক্ত করে রাখা যায়) থাকবে। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে ১৩ জন করে আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবেন। এর বাইরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরাসহ বিভিন্ন বাহিনী নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়ায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা অথবা ভোটকক্ষের সংখ্যা বাড়তে পারে।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়ায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা অথবা ভোটকক্ষের সংখ্যা বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আসবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসির উদ্যোগে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক মতবিনিময় সভা হতে যাচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। এই সভায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, পুলিশ, র্যাব, আনসার, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। সভায় ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন হয় সম্পূর্ণ ‘একতরফা’। একক প্রার্থী থাকায় ১৫৩টি আসনে তখন ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচন দেশজুড়ে ‘রাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পায়। সবশেষ ২০২৪ সালের ভোট ছিল ‘ডামি’ নির্বাচন।
সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের নির্দেশনায় পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আগামী নির্বাচনে পুলিশ যাতে কোনো দলের প্রার্থীর পক্ষ কাজ না করে, সে জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যে লটারি করে ৬৪ জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই পদ্ধতিতে নির্বাচনের আগে দেশের সব থানার ওসি পরিবর্তন করা হবে। এ ছাড়া অতীতের বিতর্কিত ভূমিকা থেকে বের করে আনতে নির্বাচনের সময় করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে পুলিশের দেড় লাখ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৬০ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসে মধ্যে অন্য সদস্যদের প্রশিক্ষণ শেষ হবে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের মহড়া ও ব্যবহার হতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন। বিভিন্ন পক্ষ গুজব ছড়িয়েও আতঙ্ক তৈরি করতে পারে। এর পাশাপাশি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারেন, এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের নির্দেশনায় পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঢাকা বিভাগে জেলা রয়েছে ১৩টি। এসব জেলায় ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৮ হাজার ৩১টি। এর পাশাপাশি ঢাকা মহানগর এলাকায় ভোটকেন্দ্র রয়েছে ২ হাজার ১৩১টি। সব মিলিয়ে ভোটকেন্দ্র ১০ হাজার ১৬২টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৭৫টি ভোটকেন্দ্র অতি ঝুঁকিপূর্ণ।
ঢাকার ২৬% কেন্দ্র অতি ঝুঁকিপূর্ণ
ঢাকা বিভাগে জেলা রয়েছে ১৩টি। এই ১৩টি জেলা নিয়ে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ। এসব জেলায় ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৮ হাজার ৩১টি। এর পাশাপাশি ঢাকা মহানগর এলাকায় ভোটকেন্দ্র রয়েছে ২ হাজার ১৩১টি। সব মিলিয়ে ভোটকেন্দ্র ১০ হাজার ১৬২টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৭৫টি ভোটকেন্দ্র অতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেই হিসাবে ঢাকার (বিভাগ, মহানগরসহ) প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ ভোটকেন্দ্র অতি ঝুঁকিপূর্ণ।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি মুন্সিগঞ্জে, ২৭২টি। এরপর কিশোরগঞ্জে ২৪৩টি।
এ ছাড়া অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র—নরসিংদীতে ২৩৭টি, মাদারীপুরে ২২৪টি, গোপালগঞ্জে ১৯০টি, নারায়ণগঞ্জে ১৬৩টি, টাঙ্গাইলে ১৬০টি, ফরিদপুরে ১৫৪টি, শরীয়তপুরে ১২২টি, মানিকগঞ্জে ৬৭টি, গাজীপুরে ৫১টি, রাজবাড়ীতে ২৯টি এবং ঢাকা জেলায় (মহানগরের বাইরে) ৬৮টি।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের কর্মকর্তারা বলেন, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলায় আওয়ামী লীগের আধিপত্য ছিল। দলটির নেতা-কর্মীরা এসব এলাকার ভোটকেন্দ্রে নাশকতার চেষ্টা করতে পারেন। তাই ঢাকা বিভাগে অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
ঢাকার পর অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগের ১১টি জেলায় ভোটকেন্দ্র ৭ হাজার ৩৪৭টি। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ১ হাজার ৪৪০টি।
পুলিশের পর্যবেক্ষণ ও তালিকায় দেশের আটটি মহানগরের ভোটকেন্দ্রগুলোর কী অবস্থা, সেটিও উঠে এসেছে। ঢাকা মহানগরের ২ হাজার ১৩১টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৬৯৫টি, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ১ হাজার ১৩৩টি।
অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চট্টগ্রাম মহানগরে ৩১২টি, সিলেট মহানগরে ৯৫টি, রাজশাহী মহানগরে ৮৭টি, গাজীপুর মহানগর এলাকায় ৮০টি, খুলনা মহানগরে ৭৯টি, রংপুর মহানগরে ৪৭টি ও বরিশাল মহানগরে ২১টি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য এবার সরকারের দিক থেকে একাধিকবার কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার কোনো দলীয় সরকার নয়। সরকারের পছন্দের কোনো দল বা প্রার্থী নেই। এর ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ার কোনো কারণ নেই।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা
সব ভিডিও করা হবে
পুলিশ সদর দপ্তরের প্রাথমিক পরিকল্পনা হচ্ছে, নির্বাচনের সময় যাঁরা সরাসরি ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকবেন, তাঁদের সবার সঙ্গে থাকবে বডি ওর্ন ক্যামেরা। ভোট গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আট ঘণ্টা কেন্দ্রের সবকিছু রেকর্ড করা হবে। এসব রেকর্ড কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হবে, যাতে ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারেন। এর পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক দলের বা কোনো প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকদের কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চান, সেটিও ভিডিও করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কোনো কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হলে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা বডি ওর্ন ক্যামেরার মাধ্যমে তার ভিডিও ধারণ করবেন। সেই ভিডিও দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া শতভাগ ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে।
পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য এবার সরকারের দিক থেকে একাধিকবার কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার কোনো দলীয় সরকার নয়। সরকারের পছন্দের কোনো দল বা প্রার্থী নেই। এর ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় অভিযান জোরদার করবে পুলিশ। নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিকদের অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সরকার ও ইসির কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।
ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর হয়তো পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। গত বছর বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে যেসব অস্ত্র–গুলি লুট হয়েছিল সেসব অস্ত্র উদ্ধার হওয়া খুবই জরুরি। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো অভিযান চালানো উচিত।