বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী বীমা খাত ইসলামিক স্টাডিজ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বৃহৎ কর্মক্ষেত্র। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডসহ অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামিক উইংগুলোতে শরিয়াহভিত্তিক গবেষণা, কমপ্লায়েন্স, মনিটরিং ও প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট—এসব ক্ষেত্রে ইসলামিক স্টাডিজ পটভূমির শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো—এই খাতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাকরির হার অনুল্লেখযোগ্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি প্রায় শূন্যের কোঠায়। অথচ একই শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি–বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সফলভাবে চাকরি পাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরে নয় কেন? সমস্যাটি কোথায়? সমাধানই বা কী?
সমস্যার মূল কারণসমূহ-ইসলামী ব্যাংকগুলোর রিক্রুটমেন্ট নীতির সীমাবদ্ধতা
বেশিরভাগ ইসলামী ব্যাংক তাদের ‘জব এলিজিবিলিটি লিস্ট’-এ ইসলামিক স্টাডিজকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখে না।
তাদের প্রধান চাহিদা থাকে—
BBA/MBA (Finance, Accounting),
Economics,
Banking & Insurance গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি।
শরিয়াহ ভিত্তিক সেক্টর হওয়া সত্ত্বেও শরিয়াহ–জ্ঞানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট নিয়োগকে তারা আলাদা গুরুত্ব দেয় না।
বাস্তবিক দক্ষতার ঘাটতি: দ্বিমুখী প্রস্তুতির অভাব
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞান শক্তিশালী হলেও নিম্ন দক্ষতাগুলোর ঘাটতি থাকে—
ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং অপারেশন,
আধুনিক ইসলামী ফিন্যান্স টুলস,
শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স পর্যবেক্ষণ দক্ষতা,
Excel, Data Management,
Case-based practical knowledge
ফলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যান।
ইন্ডাস্ট্রি–অ্যাকাডেমিয়া সংযোগের অভাব
ইসলামী ব্যাংকগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগগুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ নেই।
পরিণতিতে—
ইন্টার্নশিপ নেই,
ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট নেই,
স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্মশালা নেই,
চাকরি–বাছাই কমিটিতে ডিপার্টমেন্টের দৃশ্যমানতা নেই।
শিক্ষাক্রম আপডেট না হওয়া
যদিও সিলেবাসে ইসলামিক ইকোনমিক্স, ব্যাংকিং, বীমা আছে, তবুও তা মানসম্মত ইসলামী ফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন শেখানো হয়—
Islamic Financial Instruments
Sukuk Structure
Takaful Operation
Islamic Microfinance
Fintech & Shariah Compliance
এসব আমাদের পাঠ্যক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত নয়।
ব্যাংক পক্ষের ভুল ধারণা
অনেক ইসলামী ব্যাংকের ধারণা যে—
ইসলামিক স্টাডিজ = কেবল ধর্মীয় জ্ঞান, আর ব্যবসা পরিচালনা জানেন না।
এই স্টেরিওটাইপ এখনো দূর হয়নি।
সমাধানের প্রস্তাব: কীভাবে সুযোগ সৃষ্টি করা যায়?
ডিপার্টমেন্ট–ইন্ডাস্ট্রি MoU এবং ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক–এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক MoU করা।
প্রতি সেমিস্টারে ২০–৩০ শিক্ষার্থীকে ইন্টার্নশিপে পাঠানো।
ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স, রিসার্চ, শারীরাহ রিভিউ ইউনিটে প্রায়োরিটি দেওয়া।
স্কিল-বেসড সার্টিফিকেট কোর্স চালু
ডিপার্টমেন্ট নিজস্ব বা যৌথভাবে নিচের কোর্সগুলো চালু করতে পারে—
Certified Islamic Finance Analyst (CIFA)
Islamic Bank Operation Training
Takaful & Re-Takaful Training
Shariah Review & Audit Skills
Fintech in Islamic Banking
এই সার্টিফিকেটগুলো চাকরির যোগ্যতা বহুগুণ বাড়াবে।
পাঠ্যক্রম পুনর্গঠন
সিলেবাসে যুক্ত করা দরকার—
Islamic Banking Practice (Case-based)
Islamic Risk Management
Sukuk Structuring
Islamic Capital Market
Islamic Audit & Shariah Supervision
এতে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন অনুযায়ী প্রস্তুত হবে।
ব্যাংকিং দক্ষতা উন্নয়ন
শিক্ষার্থীদের অবশ্যই কিছু স্কিল বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হবে—
Advanced Excel
Islamic Financial Reporting
Writing Shariah Opinions
Research & Policy Drafting
এসব কাজে ইসলামিক স্টাডিজ শিক্ষার্থীরা খুব দ্রুত দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন।
বিভাগীয় অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক গঠন
ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরে চাকরি থাকা অল্প সংখ্যক অ্যালামনাইকে সামনে এনে—
ক্যাম্পাস ওয়ার্কশপ,
জব কনসালটেশন,
Mock Interview
—আয়োজন করা প্রয়োজন।
ইসলামী ব্যাংকগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক চিঠি প্রদান
ডিপার্টমেন্টের ব্যানারে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাবি জানানো যেতে পারে—
ইসলামিক স্টাডিজকে শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স, রিসার্চ ও মনিটরিং পদের জন্য বাধ্যতামূলক যোগ্যতা হিসেবে যুক্ত করা।
এবং তাদের এলিজিবল সাবজেক্ট লিস্টে Islamic Studies অন্তর্ভুক্ত করা।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইসলামী ব্যাংকিং জগতে সফল হতে পারে—এমন সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা তারা বহুবার প্রমাণ করেছে। কিন্তু নীতিগত অগ্রাধিকার না থাকা, স্কিল ও নেটওয়ার্কের অভাব, পাঠ্যক্রম–ইন্ডাস্ট্রি অসামঞ্জস্য এবং ব্যাংকগুলোর সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি—এগুলোই মূল বাধা।
সমন্বিত উদ্যোগ নিলে—বিভাগ, শিক্ষার্থী, এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো—একত্রে কাজ করলে এই বড় জব মার্কেট সম্পূর্ণই উন্মুক্ত হতে পারে।
ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টর কেবল একটি চাকরির ক্ষেত্র নয়—এটি একটি জাতীয় অর্থনীতির ভরকেন্দ্র। সেখানে ইসলামিক স্টাডিজ পটভূমির শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অত্যাবশ্যক। এখন প্রয়োজন সুপরিকল্পিত অগ্রযাত্রা।
লেখক : অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।