প্রায় ২০ বছর আগে ভারতে ‘বিভীষিকাময় বাংলো’ হিসেবে পরিচিত একটি বাড়ির কাছ থেকে ১৯ নারী ও শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার হয়েছিল। এত বছরের পুরোনো এ ঘটনাটি আবার আলোচনায় এসেছে। কারণ, এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত দুজনের শেষজন সুরেন্দ্র কোলি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন।
১২ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বিচারাধীন শেষ মামলায় সুরেন্দ্রকে খালাস দেন। নির্যাতনের মুখে তিনি নরমাংস ভক্ষণ ও মৃতদেহের সঙ্গে যৌনকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর এমন দাবি আদালত আমলে নিয়েছেন।
ডি৫-নিচু বাংলা ঘরটি—এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে; সুসজ্জিত, ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা বাড়ির সারির মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ে। বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত পড়ে থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে এক আগুনের ঘটনায় পুড়ে যাওয়া চিহ্ন রয়েছে। ওই আগুনে অবকাঠামোটির কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিল।
ঘটনাটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের। রাজধানী নয়াদিল্লির কাছে নয়ডা এলাকায় পুলিশ একটি বাংলো খুঁজে পায়, যেখানে নারী ও শিশুদের হত্যা, অঙ্গহানি ও কিছু ঘটনায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাড়ির আশপাশ থেকে মানবশরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাওয়ার পর ব্যবসায়ী মণীন্দ্র সিং পান্ধের ও তাঁর সহকারী সুরেন্দ্র কোলিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অভিভাবকেরা পুলিশের বিরুদ্ধে দুই বছরের বেশি সময় ধরে তাঁদের শিশুদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে নির্বিকার থাকার অভিযোগ আনেন। এ ঘটনার মাধ্যমে ভারতের গভীর সামাজিক বৈষম্যও সামনে আসে। কারণ, অভিজাত এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছিল এবং এর বেশির ভাগ ভুক্তভোগী ছিল পার্শ্ববর্তী নিঠারি বস্তির মানুষ।

এই দুই ব্যক্তিকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন তাঁরা কারাগারে কাটান। তথ্যপ্রমাণের অভাবে আদালত ২০২৩ সালে মণীন্দ্র সিংকে মুক্তি দেন। এরপর তাঁর সহকারী সুরেন্দ্রও কারামুক্ত হলেন। এর মাধ্যমে ভারতের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর একটির দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার অবসান ঘটল।
‘তাহলে কারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করল’
রায় ঘোষণার কয়েক দিন পর বিবিসি নিঠারিতে গিয়ে দেখেছে, বেশির ভাগ ভুক্তভোগীর পরিবার এখন আর সেখানে থাকে না। এখনো সেখানে যাঁরা থাকেন, তাঁদের দুজন বলেন, অপ্রত্যাশিত হলেও তাঁরা আদালতের আদেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে বিস্ময়ের সঙ্গে তাঁরা বলেন, ‘যদি মণীন্দ্র ও সুরেন্দ্র না করে থাকেন, তাহলে কারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করল?’
মুক্তি পাওয়ার পর দেওয়া সাক্ষাৎকারে মণীন্দ্র সিং নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। কারামুক্তির পর সুরেন্দ্র কোলিকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি আর তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্যও করেননি। তবে তাঁর আইনজীবী যুগ মোহিত চৌধুরী বলেছেন, ‘তার বিরুদ্ধে আনা সব সাক্ষ্যপ্রমাণই বানোয়াট।’
কেউ যখন হারিয়ে যায়, এর কোনো সমাধান বা শেষ নেই। এটা একটা ক্ষতে পরিণত হয়, ক্রমে তা দগদগে হতে থাকে। সব সময় মনে হতে থাকে, তারা কোথায় আছে; কী অবস্থা?— ঝাব্বু কানৌজিয়া, ভুক্তভোগী শিশু জ্যোতির বাবা
সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে মোহিত চৌধুরী বলেন, ‘যে ১৩টি মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ১২টিতেই তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। একটি মামলা বাকি ছিল, যেখানে পাঁচটি আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তবে আজ সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলাটিতেও আগের চার–পাঁচটি রায় বাতিল করেছেন। এগুলো অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ ছিল।’
তবে নিঠারির অনেকেই আদালতের এ রায় মেনে নিতে পারছেন না। সুনীতা কানৌজিয়ার ১০ বছর বয়সী মেয়ে জ্যোতি ২০০৫ সালের গ্রীষ্মে নিখোঁজ হয়েছিল। ডিএনএ টেস্টে প্রমাণ হয় ভুক্তভোগীদের মধ্যে জ্যোতিও ছিল। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘তাহলে কোন হিসেবে তাঁরা ১৮ বছর কারাগারে ছিলেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা ওকে হত্যা করেছে, ঈশ্বর তাদের কখনো ক্ষমা করবেন না।’
সুনীতার স্বামী ঝাব্বু কানৌজিয়া এই সিরিয়াল কিলিং উদ্ঘাটনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি সুরেন্দ্রর খালাস পাওয়ার খবরে চরম হতাশা প্রকাশ করেন এবং এ মামলাসংক্রান্ত সব নথি পুড়িয়ে ফেলেছেন। এগুলো তিনি বিগত বছরগুলোতে সংগ্রহ করেছিলেন।
ঝাব্বু বেশ কয়েক বছর মণীন্দ্র সিংয়ের বাসার সামনে অভিজাত লোকদের জামাকাপড় ইস্ত্রি করার কাজ করতেন। তাঁর মেয়ে নিখোঁজের পর ১৫ মাস ধরে তিনি নিয়মিত থানায় যাওয়া–আসা করতেন। তিনি বলেন, ‘কেউ যখন হারিয়ে যায়, এর কোনো সমাধান বা শেষ নেই। এটা একটা ক্ষতে পরিণত হয়, ক্রমে তা দগদগে হতে থাকে। সব সময় মনে হতে থাকে, তারা কোথায় আছে; কী অবস্থা?’
যেভাবে সামনে আসে এ রোমহর্ষক ঘটনা
ঝাব্বু কানৌজিয়া ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের দুপুরে পয়োনিষ্কাশন নালায় ঢুকে খুলি, হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করা ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। তাঁর মতে, খুলির সংখ্যা আদালতে বলা সংখ্যা অর্থাৎ ১৯টির চেয়ে অনেক বেশি।
এখন বারবার যে প্রশ্নটা উঠছে, তা হলো—‘তারা যদি দোষী না হয়, তাহলে কে? আর আমাদের সন্তানদের সঙ্গেই বা কী ঘটেছে?’
দুজনের খালাস পাওয়ার ঘটনায় ঝাব্বু কানৌজিয়ার সেই পুরোনো ক্ষত আবার জেগে উঠেছে। তবে তিনি বলেন, আরও যে লড়াই চালিয়ে যাবেন, সে সামর্থ্যের ওপর আর ভরসা করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ; আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।’
ডি৫–নিচু বাংলা ঘরটি—এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে; সুসজ্জিত, ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা বাড়ির সারির মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ে। বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত পড়ে থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে এক আগুনের ঘটনায় পুড়ে যাওয়া চিহ্ন রয়েছে। ওই আগুনে অবকাঠামোটির কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিল।
বাড়িটির প্রবেশপথ রুক্ষ ইট ও মাটির দেয়াল দিয়ে বন্ধ করা। উজ্জ্বল গোলাপি ফুলের ঝোপালো বাগানবিলাস ফুল সামনের সীমানা পেরিয়ে উপচে পড়েছে। বাইরের খোলা নর্দমায় প্লাস্টিকের ব্যাগ ও বোতলগুলো কয়লার মতো কাদাপানির মধ্য দিয়ে ভাসছে। নর্দমার দুর্গন্ধ বাতাসে তীব্রভাবে মিশে আছে।
এরপর আমরা বাড়ির পেছনের দিকে যাই। সেখানে পাপ্পু লাল সেই জায়গাটি দেখান, যেখানে মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং ভুক্তভোগীদের জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল। ‘আমি সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা এখনো ভুলতে পারি না’—বলতেই কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে তাঁর। তবে তিনি হাল না ছাড়তে বদ্ধপরিকর। পাপ্পু বলেন, ‘আমি পুলিশের কাছে যাব এবং নতুন করে অভিযোগ দায়ের করব। আমাদের সন্তানদের কে হত্যা করেছে, তা তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
পাপ্পু লাল এখন ন্যায়বিচার পেতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমাদের লড়াই এখন সরকারের সঙ্গে। অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার কিছু দায়দায়িত্ব তাদেরও আছে। আমাদের শিশুরা কি ভারতের সন্তান নয়?’
কয়েকজন আইনবিশেষজ্ঞের মতে, পরিবারগুলোর কাছে একটি শেষ সুযোগ আছে। সেটি হলো পুনরায় তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা। অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন লোকুর বলেন, এতে কোনো ফল আসবে বলে মনে হয় না।