Image description
৩২ প্রকল্পে তহবিল ঘাটতি মোকাবিলা

বত্রিশটি উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল ঘাটতি মোকাবিলায় তেরোটি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে অর্থায়নের প্রস্তাব পাঠিয়েছে সরকার। ডলার সংকট ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে মন্থর প্রবৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে দুটি প্রস্তাব সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বৈদেশিক সহায়তা অনুদান’ কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্তের আলোকে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, দাতাদের ওপর ঋণের জন্য বাড়তি নির্ভরতা ভবিষ্যতে ঝুঁকির শঙ্কা তৈরি করতে পারে। আর অর্থ বিভাগের ঋণসংক্রান্ত বুলেটিনে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ টেকসই রাখার ক্ষেত্রে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের যাচাই কঠোরভাবে করতে হবে। পাশাপাশি আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

অর্থ বিভাগের হিসাবে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি মিলে মোট ঋণ হচ্ছে ২১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক ৯ লাখ ৪৯ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি; যেখানে সরকারি ও সরকারি-গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ ১৩ বছরে তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।

এদিকে দাতাদের কাছে অর্থায়নের জন্য প্রস্তাব পাঠানোর আগে প্রকল্পের বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতির মানদণ্ড ঠিক করতে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী। বৈদেশিক সহায়তা অনুদানসংক্রান্ত বৈঠকে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের উদ্দেশ্য, যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে অগ্রসর হলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।’

ইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈদেশিক সহায়তায় বাস্তবায়নের জন্য ৩৬টি প্রকল্পের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে চারটি সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে। বাকি প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতাদের কাছ ঋণ চাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ অনুসন্ধানের অগ্রগতি এক মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অবহিত করবে ইআরডির অনুবিভাগ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, ‘দাতাদের ওপর নির্ভরতা বাড়লে ঋণের শর্ত কঠিন হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে।’ তিনি বলেন, ‘ঋণ জিডিপির অনুপাতে উদ্বেগজনক না হলেও পরিশোধের ক্ষমতা কতটুকু সেটি বিবেচনা করতে হবে। ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না করে অপচয় করা হলে পরিশোধের সক্ষমতা থাকবে না। ঋণের সঠিক ব্যবহার না হলে সেটি উদ্বেগজনক হবে। কারণ বাজেটের একটি অংশ চলে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধ ব্যয়ে। এজন্য ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সিলেকটিভ ও সতর্ক হতে হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে, ঋণের অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে হবে।’

সূত্র জানায়, দাতাদের কাছে যেসব প্রকল্পের জন্য ঋণ চাওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন বাড়ানো, সিলেটের সুরমা নদীর উভয় পাশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং গ্রাম অঞ্চলে একশ মিটারের ব্রিজ নির্মাণ, রায়পুরে ১৫০ মেগাওয়াট গ্রিড পাওয়ার প্ল্যান্ট, রেলের কনটেইনার ডিপো তৈরি, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রেলওয়ের ইলেকট্রিক্যাল টানজেকশন বাস্তবায়ন, ২০০ মিটার গেজ যাত্রীবাহী বগি ক্রয়, তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার, নদীর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পরিবর্তন; চটগ্রামে বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডসশিপ হাসপাতাল স্থাপন এবং ইনস্ট্রুমেন্ট কম্পোনেন্ট ক্রয়; ঢাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও শোধনাগার প্রকল্প। তালিকায় আরও আছে-জেলাকেন্দ্রিক হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নির্মাণ, ঢাকার ধামরাইতে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, টেকসই অর্থায়নে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ; বুয়েটে গবেষণা ও উদ্ভাবনী পার্ক তৈরি, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণ, ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাব আধুনিকায়ন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং সেতু বিভাগের মুক্তারপুর ব্রিজ নির্মাণ।

সূত্র জানায়, বৈদেশিক ঋণ অনুসন্ধান কমিটিতে প্রস্তাবিত প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্পের সম্ভাব্য সমীক্ষা সম্পন্ন এবং অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে দাতাদের কাছে অর্থ চেয়ে প্রস্তাবের চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সেখানে ঋণের পাশাপাশি দাতাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য অনুদান পাওয়ার ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে অনুবিভাগগুলোকে।

সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের জন্য ১৩টি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংস্থাগুলো হলো-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, জাইকা, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), চীন, কোরিয়া, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি), ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি), ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি), গ্রেটস ফাউন্ডেশন, আইএসডিবি ও ইউনাইটেড আমিরাটস (ইউএই)।

এসব সংস্থার কাছে ইআরডির সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ থেকে অর্থের প্রস্তাব পাঠিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বৈঠকে। এছাড়া অর্থায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী অন্বেষণে দ্বৈততা পরিহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব অনুবিভাগকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ, অর্থনৈতিক সংকট, আস্থার অভাব, জুলাই অভ্যুত্থান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিসহ নানা কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও স্থবিরতার মুখে আছে। শিল্পের উৎপাদনও কমছে। এর প্রভাবে সন্তোষজনক রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। আর আয় কম হওয়ায় সরকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত বেশি হচ্ছে। সে ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে পুনরায় ঋণ করতে হচ্ছে।

অর্থ বিভাগের ঋণ মানদণ্ডে যদিও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো মধ্যম পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘সুরক্ষিত সীমা’র মধ্যে রয়েছে, তবে কিছু অর্থনৈতিক সূচক এখন সতর্কতার সংকেত দিচ্ছে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের ত্বরান্বিত ব্যবস্থা এবং রপ্তানি আয় সম্প্রসারণ ও বৈচিত্র্যকরণের প্রতি আরও গভীর মনোযোগ প্রয়োজন।