সারাদেশে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে সম্পূর্ণ গুজব কিংবা টার্গেট করে যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চলছে অপপ্রচার, সবই ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা
অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গত ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করে। এ নির্বাচনকে ঘিরে বাড়ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে এমন গুজবও ছড়ানো সম্ভব হচ্ছে যা শুধু কয়েকটি কেন্দ্রেই নয়। পুরো নির্বাচনকেই বানচাল করে দিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনকেন্দ্রিক এআই নিয়ে প্রস্তুতি থাকলেও কিছুটা দুশ্চিন্তা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে তা প্রতিরোধে প্রযুক্তিবিদদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চাইব। এছাড়া এবারের নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করা হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশও তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে নির্বাচন ঘিরে ভোটের মাঠে ৯০ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ সেনা, দেড় লাখ পুলিশ ও সাড়ে ৫ লাখ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবে।
ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি সেবাদাতা কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাব্বিরের মতে, নির্বাচনকালীন এআই ভিত্তিক অডিও-ভিডিও ব্যবহার বা কোনো প্রচার চালাবো না। এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা নীতিমালা বা গাইডলাইন থাকা উচিত। নতুবা প্রযুক্তির এ অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব নয়। সাব্বির আহমেদ জানান, এআইয়ের মাধ্যমে অডিও-ভিডিও তৈরিতে নির্ধারিত সফটওয়্যারে ভোট কিংবা নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু নীতিমালা থাকলেও দ্রুত শব্দগত পরিবর্তন করে খুব সহজেই গুজব বা অন্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো সম্ভব হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে সম্পূর্ণ গুজব কিংবা টার্গেট করে যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। যা ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। এতে অনেকেই মিশ্রপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। কেউ বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ তুঙ্গে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচনে অংশ নিতে ও দলের হাল ধরতে নভেম্বর মাসেই লন্ডন থেকে দেশে ফেরার কথা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের।
ইতোমধ্যেই দলটির পক্ষ গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে প্রার্থী চূড়ান্ত করলেও পিআর ইস্যুতে এখনো অনড় অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী। নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবি জানিয়ে আসছে উদীয়মান তরুণ রাজনীতিবিদরা। নির্বাচন কমিশন তারুণ্যনির্ভর এই দলটিকে নভেম্বরের প্রথম দিকে শাপলা কলি দিয়েছে।
এছাড়া সরকারের নিষেধাজ্ঞায় আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচন থেকে ছিটকে গেলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সংঘটিত হওয়ার চেষ্টায় প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করার চেষ্টা করছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বাড়িতে তিন দেশের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ নিয়ে জনমনে নানা গুঞ্জন চলছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ইতোমধ্যেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন অর্থবহ বা বিশ্ব দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এসব ইস্যুকে সামনে এনে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হয়ে উঠেছে। অনেকেই এই মাধ্যম ব্যবহারে উল্লেখ করছেন, শীঘ্রই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়েও অনেক অডিও-ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব চলছে। অনেকেই বলছেন, ত্রয়োদশ নির্বাচন হবে না। নানা কারণে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব দেখে সত্য মনে হলেও কিছু ভিডিও আসলে নকল ও এআই জেনারেটেড। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর এমন সব ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু প্রচারণার বাইরেও এমন সব ভিডিও রয়েছে যেখানে চালানো হচ্ছে অপপ্রচার। ভুল তথ্য কিংবা গুজবও ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে উঠছে এসব ভিডিও। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন হচ্ছে, কোনটি আসল আর কোনটি নকল। জানা যায়, লার্নিং বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে ডিজাইন, অ্যানিমেশনসহ এআই কনটেন্ট তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বললেন, চ্যাটজিপিটি বা এআইসহ নানা সফটওয়্যার দিয়ে দ্রুত তৈরি করে খুব সহজেই তৈরি হচ্ছে ভিডিও। এছাড়া ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি সেবাদাতা কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাব্বির তার ক্যারিয়ারে ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়ন, ইন্টারনেট নীতি প্রণয়ন, সাইবার নিরাপত্তা, ইন্টারনেট গভর্নেন্সের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন।
লার্নিং বাংলাদেশের সিইও সাব্বির আহমেদ জানান, আমার ভোট আমি দিয়েছি আর আমার সঙ্গে পুরো এলাকার মানুষ, এবার নির্বাচনে আমরা জয়ী হবোই, এটা হচ্ছে ডায়ালগ। এটা দিয়ে একটা ভিডিও বানাবো, সে আমাকে একদম ডিটেইলে দ্রুত লিখে দিচ্ছে। গুগলে দিয়ে দিলেও এটা বানিয়ে দেবে। এসব ভিডিও তৈরিতে নির্ধারিত সফটওয়্যারে ভোট কিংবা নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু নীতিমালা থাকলেও দ্রুততম শব্দগত পরিবর্তন করে খুব সহজেই গুজব বা অন্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, টেক্সট দিয়ে একটা ভিডিও জেনারেট করে ফেলতে পারছেন এআই ব্যবহারকারীরা। হয়ত এটা নতুন এনভায়রনমেন্ট। যা ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ একই আছে।
ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি সেবাদাতা কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাব্বির জানান, ত্রয়োদশ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই নির্বাচনে এআইয়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে যত আলোচনা তা রোধে এখনো সরকারের তেমন প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত জায়গা থেকে, প্রতিষ্ঠানের জায়গা থেকে তা প্রতিরোধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা নীতিমালা বা গাইডলাইন থাকা উচিত যে, আসলে কোন কোন জায়গায় আমরা এভাবে ব্যবহার করব আর কোন কোন জায়গায় আমরা করব না। বা সব দল মিলে যদি একটা ঐকমত্যে পৌঁছায় যে, আমরা এ নির্বাচনকালীন সময়ে এ ধরনের প্রচারণা করব না। এআই বেসডভিত্তিক অডিও-ভিডিও আমরা ব্যবহার করব না।
আগামী নির্বাচন ঘিরে এআইয়ের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করেছে নির্বাচন কমিশন। আর এআই দিয়ে কোনো অপরাধমূলক কাজ করলে ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানিয়েছে কমিশন। কিন্তু সে শাস্তির প্রক্রিয়া কেমন হবে বা অপরাধীদের কীভাবে আইনের আওতায় আনা যাবে সেটা এখনও স্পষ্ট করেনি নির্বাচন কমিশন।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কেন্দ্রীয়ভাবেই নয়, একেবারে জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে এসব অপরাধীদের ধরা গেলে হয়ত আগামী নির্বাচন অনেকটাই স্বচ্ছ হবে। তারা জানান, এমন সব মারাত্মক গুজব এআইয়ের মাধ্যমে ছড়ানো সম্ভব, যা শুধু কয়েকটি কেন্দ্রেই নয়, পুরো নির্বাচনকেই বানচাল করে দিতে পারে। নির্বাচনের দিন বা আগে ইসিকে এমন একটি ওয়েবসাইট লঞ্চ করতে হবে, যাতে দ্রুতই কোনটি এআই কন্টেন্ট সেটা বুঝতে পারে সাধারণ মানুষ। এতে বিদ্যুতের গতিতে ছড়ানো ভুল তথ্যও ঠেকানো সম্ভব হবে।
এমন বাস্তবতায় আগামী নির্বাচনে এমন অপপ্রচার রোধ করা কতটা সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক এআই নিয়ে প্রস্তুতি থাকলেও কিছুটা দুশ্চিন্তা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে তা প্রতিরোধে প্রযুক্তিবিদদের কাছ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চাইব।
এদিকে সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভা শেষে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, এবারের নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করা হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশও তৈরি করা হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে ভোটের মাঠে ৯০ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ সেনা, দেড় লাখ পুলিশ ও সাড়ে ৫ লাখ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবে।
নানা জায়গায় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। ভোটের পরিবেশ আছে কি ? এ প্রসঙ্গে সচিব জানান, সভায় আগুন লাগার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। গতবছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী লুণ্ঠিত অস্ত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লুট হওয়া ৮৫ শতাংশ রিকভারি হয়েছে, বাকিটা হয়নি। উদ্ধারের কাজ চলমান।