Image description

জুলাই আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে। কোটা সংস্কার করে বৈষম্যমুক্ত চাকরি পদ্ধতি চালু করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। রক্ত ঝরিয়ে এ দেশের ছাত্র-তরুণরা স্বৈরশাসনের পতন ঘটায়। কিন্তু যে দাবিতে জুলাই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই বৈষম্যহীনভাবে সরকারি চাকরি প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা কি পূরণ হয়েছে?

গত ১৫ মাসে সরকারি চাকরিতে বৈষম্য মুক্তি হয়নি, বরং চাকরি প্রাপ্তিতে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজির মহামারি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সবচেয়ে বড় নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে এখন। প্রাথমিক স্কুলে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে সারা দেশে চাঁদাবাজির রীতিমতো উৎসব শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় চাকরি লাভে ইচ্ছুক প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন সমন্বয়ক পরিচয়ে কিছু তরুণ। আবার অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারাও চাকরির আশ্বাস দিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা থেকে প্রাথমিক শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করা একজন বললেন, একটি সূত্র থেকে তিনি জানতে পারেন, চাকরির জন্য সমন্বয়কদের সুপারিশ লাগবে। সমন্বয়করা যদি বলেন, এই প্রার্থী আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়, একমাত্র তাহলেই তার চাকরি হতে পারে।

অতঃপর তিনি, তার জেলার একজন সমন্বয়কের কাছে ধরনা দিলেন। সমন্বয়ক তার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করলেন। এবং এটাও জানিয়ে দিলেন যে, এই টাকা চাকরির জন্য নয়, সমন্বয়ক শুধু শনাক্ত করবেন যে, প্রার্থী আওয়ামী লীগের দোসর নন। ওই প্রার্থী এ ধরনের প্রস্তাব শুনে হতবাক। তিনি এখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তার এই বক্তব্যের সূত্র ধরে, সারা দেশে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। অলিখিতভাবে নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে যে, চাকরিপ্রত্যাশীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এই মর্মে সত্যায়ন লাগবে। এই সত্যায়ন দেবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা।

শুধু প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নয়, অঘোষিতভাবে এই নিয়ম চালু করা হয়েছে সব সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে। এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য চাঁদাবাজিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। ব্যাংকে নিয়োগেও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সদস্যভুক্ত ৯টি ব্যাংক ও ২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ‘সিনিয়র অফিসার (সাধারণ)’ পদের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আগামী ৫ ডিসেম্বর প্রিলিমিনারি (এমসিকিউ) ও ১৯ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মোট ১ হাজার ৫৫৪টি শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। একাধিক আবেদনকারী এ ধরনের অভিযোগ করেছেন। তারা দাবি করেছেন, তাদের মুঠোফোনে কল করে বলা হয়েছে, চাঁদা না দিলে পরীক্ষায় যতই ভালো ফল করুক না কেন, চাকরি হবে না। আওয়ামী লীগের দোসর নয়- এই প্রত্যায়ন ছাড়া কোনো সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না, এ রকম অঘোষিত নিয়ম চালু হয়েছে সব সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। সংশ্লিষ্ট একাধিক ভুক্তভোগী বলছেন, আগে সরকারি চাকরি হতো ঘুষের বিনিময়ে। এখন চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় চাঁদাবাজদের কাছ থেকে।

মেধা ভিত্তিক চাকরির জন্য যে লড়াই শুরু হয়েছিল ক্ষমতার হাতবদলের পর এখন চাঁদাবাজির হাতে সেই স্বপ্ন বন্দি হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে সরকারের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তারা বলেন, সরকার সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। কেউ যদি এ ধরনের প্রতারকচক্রের সঙ্গে লেনদেন করে থাকেন তবে সেটা তার অপরাধ। জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলছেন, সরকারি চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো সত্যায়ন প্রয়োজন নেই।

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, এ রকম শনাক্ত পত্র ছাড়া আবেদনকারীকে পরীক্ষার হলেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। মব করে তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।