বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে। এতে সহায় সম্বলহারা হন নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষ। আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়। আগুনের কারণ এবং ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশও দেয় কমিটি। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়মিতই হচ্ছে। বিভিন্ন তদন্তে উঠে আসে এই বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের নানা কারণ। এর মধ্যে দুর্বল অবকাঠামো, অবৈধ গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগকে অগ্নিকাণ্ডের বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়।
সেখানে বসবাসরত বাসিন্দাদের অসচেতনতাকে আগুনের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। আবার বারবার এসকল আগুনের পেছনে নাশকতাকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। ফায়ার সার্ভিস বলছে, কড়াইল বস্তিতে পূর্বের অগ্নি দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন বস্তির অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পরবর্তী তদন্তে বেশির ভাগ সময়ই দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে অগ্নি দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে।
এসব বস্তিতে অসংখ্য বিদ্যুতের সংযোগ অবৈধভাবে টানা থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেগুলো আবার থাকে পুরনো তারের। আবার সেই চোরাই সংযোগে হিটারও চালানো হয়। থাকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। দাহ্য বস্তুতে বৈধ-অবৈধ অনেক কিছুই থাকে এই বস্তিতে। যার কারণে ঘনঘন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর মহাখালী কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দেড় হাজারের মতো ঘর-বাড়ি ও মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে নিঃস্ব হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত পেরিয়ে দিনভর অবস্থান করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার। ঘরের ছাই ও পোড়া টিনের স্তূপের মধ্যে খুঁজে ফেরেন তাদের শেষ সম্বলটুকু। আগুন লাগার ঘটনার পরে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের চেষ্টায় দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা পর বুধবার সকালে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহত ও প্রাণহানি ঘটেনি। কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটিকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। আগুন লাগার পরপর বস্তির বিভিন্ন ঘরে থাকা রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার একের পর এক বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। এতে দ্রুত আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে চলতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এই বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যায় অসংখ্য ঘর। গত বছরের ২৪শে মার্চ ও ১৮ই ডিসেম্বরেও আগুনে পুড়ে কড়াইল বস্তির অংশ বিশেষ। প্রায় নব্বই একর জায়গার ওপর ১০ হাজারের মতো ঘর রয়েছে এই বস্তিতে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার খবর পাওয়ার ৩৫ মিনিট পর তিনটি স্টেশনের ইউনিট সেখানে পৌঁছায়। ঢাকার যানজটই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। বড় গাড়িগুলো সরু রাস্তায় ঢুকতে পারেনি। বাধ্য হয়ে দূর থেকে পাইপ টেনে আগুন নেভানোর কাজ করতে হয়েছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই আগুন ‘ডেভেলপমেন্ট স্টেজে’ পৌঁছে যায়। যত্রতত্র বিদ্যুতের তার এবং বাসায় থাকা গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে আগুনের উৎস তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই কড়াইল বস্তিতে ফায়ার সার্ভিস মহড়া আয়োজন করে। কিছুদিন আগেই সর্বশেষ মহড়া করা হয়েছিল। সে জন্য দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে; না হলে আরও দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগতে পারতো। পর্যাপ্ত পানি পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি, ওয়াসা এবং পাশের ড্রেনের পানি ব্যবহার করা হয়েছে। তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বস্তিতে বিভিন্নভাবে কথা বলে আমরা জানতে পেরেছি আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, কোন আন্দোলন সংগ্রামের সময় কিংবা পরবর্তী পরিস্থিতিতে যে অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা থাকে। কড়াইল বস্তিতে তো এর আগে বহুবার আগুনের ঘটনা ঘটেছে সেই সময়গুলো কখন? আমরা দেখি অধিকাংশ সময় হলো আন্দোলনের সংগ্রামের সময়। কিংবা আন্দোলন পরবর্তী অবস্থায় নানাভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করার সূত্র ধরে বস্তি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা কিংবা নানা জায়গাতে নানা ভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর আমাদের এখানে তো প্রান্তিক বা সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে পুঁজি করে রাজনীতি তো বহু হয়েছে আরও হবে। যদি ত্রুটি থাকে বা কোনো ধরনের সতর্কতার ঘাটতি থাকে সেটা কীভাবে সংশোধন করা যায় সেক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা নিবে সেটা আমরা প্রত্যাশা করি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার মানবজমিনকে বলেন, কড়াইল বস্তির মঙ্গলবারের অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বিধায় সে বিষয়ে এখনই কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে কড়াইল বস্তির আগের অগ্নি দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন বস্তির অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পরবর্তী তদন্তে বেশির ভাগ সময়ই দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক থেকে অগ্নি দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। তিনি বলেন, বস্তির অগ্নি দুর্ঘটনার জন্য মূল ঝুঁকিগুলো হলো; অসাবধানতা, অনিরাপদ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ ও ব্যবহার, বিড়ি-সিগারেট, মশার কয়েল ও খোলা বাতির ব্যবহার।
নিঃস্ব দেড় হাজার পরিবার
মোসাম্মৎ বানু। একদিন আগেও ঘর-সংসার, আসবাবপত্র সবই ছিল তার। মঙ্গলবার মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুন সব কেড়ে নিয়েছে তার। শুধু একটি পাটি আর ভর দিয়ে হাঁটা লাঠিই এখন অবলম্বন এই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধার। তাই গতকাল দুপুরে তার ওই পোড়া ঘরের মেঝেতে বসে বিলাপ করছিলেন মোসাম্মৎ বানু। অশ্রুসিক্ত হয়ে বারংবার বলছিলেন-কিচ্ছু নেই ঘরে, আমার ঘরে কিচ্ছু নেই। আমি কোথায় যাবো? কী খাবো? মানুষের তো ছেলে আছে। মেয়ে আছে। স্বামী আছে। আয়-রোজগারের লোক আছে, আমার তো ছেলেমেয়ে, স্বামী কেউ তো নেই? আমাকে কে জায়গা দিবে? আল্লাহ আমারে কেন উঠায় নেয় না! আমি এখন নতুন ঘর কোথায় পাবো? সারা জীবন ধরে যা দুই-এক টাকা জমা করেছিলাম তাও আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
মোসাম্মৎ বানু মানবজমিনকে বলেন, আমার চোখে সমস্যা, অপারেশন করা হয়েছে। এর আগে স্ট্রোক হয়েছে আমার। লাঠি ছাড়া এখন আর চলাফেরা করতে পারি না। মঙ্গলবার বস্তিতে দাউ দাউ করে আগুন লাগার পরও একা ঘর থেকে বের হতে পারিনি। দুই জনে ধরে আমাকে আগুন লাগা ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। এর আগে ২০০৪ সালে যখন আমাদের বস্তিতে আগুন লাগে তখনো একই রকম পরিস্থিতি হয়েছিল। ২০১৭ সালেও আগুনে ঘর পুড়েছে আমার। এই নিয়ে তিনবার। তিনি বলেন, আগে তো দশ জনের কাছ থেকে হাত পেতে নিয়ে এসে কোনো রকমে চলেছি কিন্তু এবার আমি কি করবো!
মোসাম্মদ বানুর মতোই কড়াইল বস্তির অন্তত ১৫ শ’ পরিবারের ঘর আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এদের বেশির ভাগই পরনের কাপড় ছাড়া ঘর থেকে কিছুই নিয়ে বের হতে পারেননি। তাই ঘর পোড়া ছাইয়ের মধ্যে গতকাল অনেক মানুষকে তন্য তন্য করে খুঁজতে দেখা যায় জীবনের শেষ সম্বল, যদি কিছু মেলে। কিছু মানুষকে আবার আগুনে পোড়া ঘরের টিন, ধাতব বস্তু, লোহা- লক্কড় জড়ো করে ভাঙাড়ির কাছে বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর সেগুলো পোড়া স্তূপের পাশেই বসে ছিলেন ফাতেমা আক্তার। মলিন মুখ, হাত দিয়ে চোয়ালে ঠেস দিয়ে বসে নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। কাছে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাতেমা বলে ওঠেন, আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার ঘর, দোকান, সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই দোকান দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। এখন কিচ্ছু নেই। আমার যত পুঁজি ছিল সব এই দোকানে ঢেলেছিলাম, কিছুই রইলো না। ফাতেমা আক্তারের ঋণের টাকা দিয়ে বানানো দোকান পরিচালনাকারী তার স্বামী শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, আমাদের দোকান, বাসা থেকে একটু দূরে ছিল। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই অসুস্থ। তাই দুজন মিলেই ভাগে দোকানটা চালাইতাম। মঙ্গলবার যখন আগুন লাগে তখন আমরা বাড়িতে ছিলাম। আগুন লাগার সময় বাইরের চিল্লাচিল্লি শুনে বাইরে এসে দেখি- আমাদের ঘরের চালে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। চারদিকে আগুন আর আগুন। প্রথমে ঘর থেকে মালপত্র বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু পারিনি। এরপর দোকানের কথা মনে পড়তেই দৌড়ে দোকানের এদিকে আসি। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। কোনোভাবেই দোকানটাকে বাঁচাতে পারিনি।
এখন শুধুমাত্র মোবাইল ফোনটা আর দু’জনের গায়ের কাপড় ছাড়া কিচ্ছু নেই আমাদের। বাসার আসবাবপত্র, থালা-বাসন, টাকা-পয়সা, স্বর্ণ সব পুড়ে গেছে। দোকান ছাড়া আমাদের কোনো আলাদা আয়ের কোনো উৎস নেই যে, তাই করে খাবো। এখন এই পৃথিবীতে আল্লাহ্ই আমাদের একমাত্র ভরসা। ১৯৯৩ সালে বরগুনা থেকে ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরি নেন মো. জসিম। ওঠেন কড়াইল বস্তিতে। কয়েক বছর চাকরি করার পর নিজেই থাকার ঘরের পাশে পাঁচটি সেলাই মেশিন কিনে শিশুদের পোশাক তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। মঙ্গলাবারের কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুন তারও ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে। জসিম বলেন- আগুন যখন লাগে তখন আমি, আমার স্ত্রী, ছেলের বউ, নাতিসহ আমরা পাঁচজন বের হয়ে গেছি। সম্বল ছিল আমার সেলাইয়ের মেশিনগুলো। এই আগুন আমার সব পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার সবগুলো সেলাই মেশিই পুড়ে শেষ।
ফাতেমা, জসিমদের মতো কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুনে সর্বস্ব খুইয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে শত শত মানুষ। বুধবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, কড়াইল বস্তির প্রবেশমুখগুলোতে শত শত মানুষ ভিড় করেছে। সকলের চোখে- মুখে হতাশার ছাপ। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, এনজিওসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা তাদের সাধ্যমতো ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করছেন। কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, কেউ পানি বিতরণ করছেন, কেউবা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় কড়াইল বস্তিতে লাগা ভয়াভহ আগুনের কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। ৫ সদস্যের কমিটির সভাপতি ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ ও সদস্য সচিব ফায়ার সার্ভিস ঢাকার পিএফএম’র সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান। কমিটির সদস্যরা হলেন- ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোন ০২-এর উপ-সহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা, ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার, মো. নাজিম উদ্দিন সরকার এবং ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা ২৩-এর ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর মো. সোহরাব হোসেন।