Image description

পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে। যা নিয়ে বিতর্ক হয়। আবার থেমেও যায়। কিন্তু প্রেস ফ্রিডম নিয়ে বিতর্ক জারি থাকে। যেমনটা আছে বাংলাদেশেও। সরকার আসে, সরকার যায়। বিতর্ক থামে না। পক্ষে না গেলেই প্রেস ফ্রিডম নিয়ে ক্ষমতাসীনরা কথা বলেন। মুহূর্তের মধ্যে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেন। নানা ছবকও দেন। মামলা মোকদ্দমা তো আছেই। ক্ষমতা হারানোর পর এরাই আবার সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এটাই স্বাভাবিক। নতুন কিছু নয়। ৫৪ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। নিজেকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। জেলেও গিয়েছি একাধিকবার। কোনো সরকারের আমলেই স্বস্তি ছিল না। বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশও ছাড়তে হয়েছে। এই মুহূর্তে কথা উঠেছে মানবজমিনের সাংবাদিকতা নিয়ে। ২৭ বছর আগে এই পত্রিকাটির জন্ম। উপমহাদেশের প্রথম বাংলা ট্যাবলয়েড দৈনিক। ট্যাবলয়েড মানেই সেক্স-স্ক্যান্ডাল ও গুজবে পরিপূর্ণ থাকবে। যেমনটা হয় পশ্চিমা দুনিয়ায়। কিন্তু মানবজমিন অনেকটাই ব্যতিক্রম। শুরু থেকেই মানবজমিন সিরিয়াস পত্রিকা হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে। 

১৯৯৮ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারি যে কাগজটির আত্মপ্রকাশ ঘটে তার শিরোনাম ছিল- হাসিনার চালে খালেদা হতবাক। দীর্ঘ সময়ে বহু সিরিয়াস অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্ম দিয়েছে মানবজমিন। এজন্য অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে পত্রিকাটিকে। পাঠকেরা তা জানেন। এ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। অন্তত তিনটি অনুসন্ধানী রিপোর্টের কথা উল্লেখ করবো যা বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে। সবার মনে আছে নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার প্রথম জমানায় ক্যাসেট কেলেঙ্কারির কথা। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তখন প্রেসিডেন্ট। একটি মামলা চলাকালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন কর্মরত বিচারপতির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। এর উপর ভিত্তি করে মানবজমিন অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে। একটি রাজকীয় কেলেঙ্কারির খসড়া- শীর্ষক এই খবর নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন তদন্তের নির্দেশ দেন। এক পর্যায়ে মানবজমিনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। তখন অনেকেরই ধারণা ছিল অন্য সংবাদমাধ্যমের মতো মানবজমিন আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবে। প্রমাণ দিতে পারবে না। কিন্তু মানবজমিন আদালতে দাঁড়িয়ে মামলা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আদালত প্রমাণ জানতে চাইলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মানবজমিন আদালতে ক্যাসেট হাজির করলো। যেখানে ছিল এরশাদ-লতিফুর রহমানের কথোপকথন । 

আদালতের কার্যক্রম এক ঘণ্টার জন্য মুলতবি করে বিচারপতিগণ ক্যাসেটের বয়ান শুনলেন। সাথে সাথে বিচারপতি লতিফুর রহমান পদত্যাগ করলেন। মামলায় নাটকীয় মোড়। এরশাদের ছয় মাসের জেল হলো। মানবজমিনের প্রধান সম্পাদকের জেল হলো এক মাসের, সম্পাদকের একদিনের।  প্রমাণ হাজির করার পর পত্রিকার সম্পাদকের কেন জেল হলো- তা আজও জানিনা। আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে দুই অভিযুক্ত এরশাদ এবং লতিফুর রহমান না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আলোচিত এই মামলায় মানবজমিনের পক্ষে আইনি লড়াই করেছিলেন প্রখ্যাত দুই আইনজীবী- ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ।

দ্বিতীয় ঘটনাটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপন নিয়ে। এটাও শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের সময়কার ঘটনা। প্রায় ১৪ বছর হারিছ চৌধুরী ঢাকার পান্থপথে একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের পরিচয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। হাসিনার প্রশাসন তাকে দেশে-বিদেশে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। গোয়েন্দারা এজন্য একাধিকবার বিদেশ সফরও করেন। 

মানবজমিনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রমাণ করে হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন পান্থপথে থাকা অবস্থায়। এর জন্য গোয়েন্দা দপ্তরে ডেকে পাঠানো হয় মানবজমিনকে। বলা হয়, এটা আজগুবি খবর। হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরীর বিরামহীন প্রচেষ্টার পর ডিএনএ টেস্টে প্রমাণিত হয় অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানই হারিছ চৌধুরী। যিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। বিতর্কের অবসান ঘটে। তবে রেখে যায় অনেক প্রশ্ন। জয় হয় মানবজমিনের অনুসন্ধানী রিপোর্টের। 

এরপরের ঘটনাটি অতি সাম্প্রতিক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে বিতর্ক যখন চারদিকে তখন মানবজমিনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট সামনে আসে। মানবজমিন প্রমাণ করে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। ব্যাপক তোলপাড় হয় দেশে-বিদেশে। 

পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই ঘটে। যা এই মুহূর্তে বলে নতুন কোনো বিতর্কের জন্ম দিতে চাই না। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, মানবজমিন এবার ধরা খাবে। পরিস্থিতি এমনই ছিল। কিন্তু সত্যের জয় ঠেকায় কে! শত চেষ্টা করেও মানবজমিনের কণ্ঠ রোধ করা যায়নি। এটা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।  

আরো অনেক রিপোর্ট নিয়ে আলোড়ন হয়েছে। যেমনটা হয়েছিল প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিয়ের খবর নিয়ে। এরশাদ বিদিশাকে বিয়ে করেছেন এই খবর প্রকাশের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কাগজ পুড়িয়ে দেয়। অফিস এবং বাড়িতে হামলা করে তার লোকজন। আখেরে কী দেখা গেল? এক মাসের মধ্যে এরশাদ-বিদিশার বিয়ের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার করা হলো। এ তো গেল কয়েকটি রিপোর্টিংয়ের বাস্তব প্রতিক্রিয়া। হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে মানবজমিন একদিনের জন্যও আপস করেনি। আটমাস দেশেই ফিরতে পারিনি। মামলা মোকদ্দমা তো ছিলই। পত্রিকার বিজ্ঞাপনও সংকুচিত করা হয়।  হাসিনার পতনের তিনদিন আগেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় আমাকে। আজ অনেকেই নিরাপদ দূরত্বে থেকে প্রেস ফ্রিডমের কথা বলছেন। এটা শুনতে ভালো লাগে, যারা বাস্তবের মুখোমুখি হননি কখনো। 

এমনকি যখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস মিডিয়ায় কার্যত নিষিদ্ধ ছিলেন তখনও মানবজমিন তার পাশে ছিল। তার বিরুদ্ধে বলা থেকে বিরত থাকার জন্য টকশো উপস্থাপনা বর্জন করেছিল কে খবর নিয়ে দেখুন। প্রাপ্তির জন্য মানবজমিন কিছু করে না। বারবার তাই প্রমাণিত হয়েছে। পাঠকেরা বলুন তো মানবজমিন প্রেস ফ্রিডমের অপব্যবহার করলো কোথায়?