Image description

একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সরকারি দপ্তর, বিমানবন্দর, পোশাক কারখানা, শপিংমলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থাপনাগুলো আধুনিক, উন্নত এবং দৃষ্টিনন্দন করতে গিয়ে যে উপাদানগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর কারণে আগুনের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ-দাহ্য বস্তু ব্যবহার করছে কিন্তু সেই অনুযায়ী সাবধানতার সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ যে মেটেরিয়ালগুলো সেটি ব্যবহার করছে না। এ ছাড়া দুর্ঘটনাস্থলে প্রথমে যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয় সেটি হলো- ওই দুর্ঘটনাস্থলের তথ্যের ঘাটতি থাকে।

স্টেকহোল্ডাদের ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে মৃত্যু, ঝুঁকি এবং সম্পদের ক্ষতি বেশি হয়। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের সোর্সগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিদ্যুতের শর্ট-সার্কিট, চুলার আগুন, গ্যাসের পাইপ ফেটে যাওয়া, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, কেমিক্যাল ইত্যাদি। মানুষের সচেতনতা এবং সাবধানতার জায়গাটা খুব একটা জোরালো না। যার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।  এসব বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু মানুষ সতর্ক হচ্ছে না। বিদ্যুতের সাব-স্টেশনগুলো ছয় মাসে দুইবার চেক করা উচিত কিন্তু ব্যবহারকারীরা সেটি করছে না। ফলে শর্ট-সার্কিটের ঘটনা ঘটছে। মানুষের ব্যাপক সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। যেখানে-সেখানে রেস্টুরেন্ট- গোডাউন বানানো হচ্ছে। মালামাল অনুযায়ী যে নিরাপত্তা প্রয়োজন তা নিচ্ছে না। আইন মানছে না অনেকে। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রত্যেকের সচেতনতা দরকার। ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে বেগ পোহাতে হয় ফায়ার ফাইটিংয়ে। আরেকটি বিষয় সহজে অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটির জন্য রাস্তায় হাই-ড্রেন ব্যবস্থাপনা থাকাটা দরকার। এই হাই-ড্রেনের চিন্তা-ভাবনা করা জরুরি। 

গত ২২শে সেপ্টেম্বর টঙ্গীর সাহারা মার্কেটের কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্যসহ পাঁচজন। ১৩ই অক্টোবর নরসিংদীর সদর উপজেলার পাঁচদোনা এলাকায় ব্যাটারি থেকে সিসা তৈরির একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হন ৭ শ্রমিক। ১৪ই অক্টোবর রাজধানীর রূপনগর শিল্প এলাকায় শাহ আলম কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে। এ ঘটনায় ১৬ জন গার্মেন্টসকর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মিরপুরের আগুনের একদিন পরে ১৬ই অক্টোবর দুপুরে চট্টগ্রামের সিইপিজেডের ১ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত ‘অ্যাডামস ক্যাপ অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড’ কারখানায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এই ঘটনার একদিন পর  ১৮ই অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন,  শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বাতাস সবচেয়ে বড় বাধা ছিল।  যেহেতু এটা খোলা জায়গা, প্রচুর বাতাস ছিল। ফলে অক্সিজেনের একটা প্রাপ্তি সব সময় ছিল, যেটা আগুনকে জ্বালাতে সহায়তা করে। আর দুই নাম্বার হচ্ছে, কার্গোর ভেতরের জায়গাগুলো খোপ খোপ করা, এই খোপ খোপের মধ্যে আবার দেয়াল দেয়া। ফলে প্রত্যেকটা খোপ পরিষ্কার করে আমাদের আগুন নেভাতে হয়েছে। অনুমোদন, ফায়ার লাইসেন্সের বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগেছে, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সেখানে যথাযথ নোটিশ প্রদান, ইন্সপেকশন করা, তাদের সতর্ক করা, লাইসেন্স না দেয়া এসব করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, দেশে রাসায়নিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসতর্কতা সর্বত্র বিদ্যামান। এর প্রমাণই হলো সাম্প্রতিক এই অগ্নিকাণ্ডগুলো। রাসায়নিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। নিয়মিত পরিদর্শন নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তা যথাযথভাবে হয় না। দায়ীদের বিরুদ্ধে কী আইনি শাস্তির বিধান আছে, কিংবা আগের ঘটনার বিচার হয়েছে কিনা? হয়নি। আইনের দুর্বলতা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহির অভাবেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। 

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, দেশ আধুনিক এবং উন্নত হচ্ছে, আধুনিক, উন্নত এবং দৃষ্টিনন্দন করতে গিয়ে যে উপাদানগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর কারণে আগুনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আগুনের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের যে সচেতনতা এবং সাবধানতার জায়গাটা আরও জোরালো করতে হবে সেই জায়গাটা মানুষ অসাবধান-অসতর্ক আছে যার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। আর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে, আধুনিক যে মেটেরিয়ালগুলো আমরা ব্যবহার করি উচ্চ দাহ্য। আগে একটি সলিট কাঠ দিয়ে খাট তৈরি হতো কিন্তু বর্তমানে আমরা খাট তৈরি করতে গেলে বিভিন্ন প্রসেসযুক্ত কাঠ ব্যবহার করছি যেগুলোতে অতিদ্রুত আগুন ছড়িয়ে যায়। আবার উপরে সিলিং এর জন্য ফলস সিলিং ব্যবহার করছি অর্থাৎ উচ্চ দাহ্য বস্তু ব্যবহার করি কিন্তু সেই অনুযায়ী সাবধানতার সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ মেটেরিয়ালগুলো ব্যবহার করি না। বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যেমন মর্ডান ইকুইপমেন্টগুলো ছিল সেগুলো খুব হাইলাইট ইকুইপমেন্ট যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। আর সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ইউনিট আছে তারা সাধারণত ফায়ার সার্ভিসকে কল না করে নিজেরাই আগুন নেভায়। ওই ফায়ার ফাইটিং ডিপার্টমেন্ট হয়তো কোনো কারণে ফেল করার পরে হয়তো আমাদের সংবাদ দিয়েছে। আমরা যখন গিয়েছি তখন আগুনটা কিন্তু অনেক বড় আকারে বিস্তরভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, যার কারণে অবধারিতভাবে একটু সময় লেগেছে। আধুনিক এবং দৃষ্টিনন্দন করার ক্ষেত্রে মানুষ যেন একটু সাবধান এবং সচেতন থাকে। 

তিনি বলেন, একটা বড় স্থাপনা আছে সেখানে ফায়ার সার্ভিস আসতে যদি ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে এসময়টাতে আগুন অনেক ডেভেলপ স্টেজে চলে যায়। যেগুলোতে অনেক মূল্যবান সামগ্রী থাকে সেগুলোতে সংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিমানবন্দরের আগুনে আমাদের যে বড় চ্যালেঞ্জটি পার হতে হয়েছে সেটি হলো, এখানে আমদানিকৃত মালামাল যেটার মধ্যে রাখা হয় সেটি হচ্ছে রুমের ভিতরে শত শত রুম, রুমগুলো মোটা লোহার গ্রিল দিয়ে রুম করা। ফলে একটা রুম যখন আমরা কাটি দেখি আরেকটি গ্রিলের রুম যার কারণে দীর্ঘ সময় লেগেছে। একটা রুমের ভেতরে শত শত রুম, হয়তো ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির মালামাল ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখার জন্য তারা এটা করেছেন। কিন্তু এগুলোতে যদি ইজি একসেস থাকতো বেগ পেতে হতো না, আমাদের জন্য ইজি হতো অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে। আধুনিক সিস্টেমগুলোতে আমি মনে করি সংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতো তাহলে আমাদের ভিতরে যাওয়া লাগতো না ভিতর থেকে এটি কাজ করে আগুনটি নিভিয়ে ফেলতে পারতো। যদি উন্নত জীবনযাপন করতে চাই তাহলে অগ্নিনির্বাপণের উন্নত ব্যবস্থাও আমাদের রাখা উচিত। এটার ব্যাপারে সবাইকে আমি উদ্ভুদ্ধ করবো।

তিনি আরও বলেন, একটা দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে যে চ্যালেঞ্জটার মধ্যে পড়ি ওই দুর্ঘটনাস্থলের স্টেকহোল্ডার কাউকে আমরা পাই না, যার কাছ থেকে সঠিক তথ্যটা আমরা নিতে পারবো। দ্বিতীয়ত হচ্ছে ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার অনেক ভিড় থাকে। যেমন টঙ্গীর ঘটনায় সঠিক তথ্য দিয়ে কেউ যদি সাহায্য করতো যে, এখানে কেমিক্যাল মেটেরিয়াল রয়েছে তাহলে আমাদের এই লোকগুলো কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে দিতাম না। সেখানে সঠিক তথ্য পেলে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যুগুলো এড়ানো যেতো। আমরা নরমাল স্ট্রাকচারাল ফায়ার ফাইটিংয়ে যেটা করি যে, একটা বাইরে থেকে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি আরেকটা ভেতর থেকে। বাইরে থেকে কখনো আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা যায় না, আমাদের লোকজনকে ভেতরে ঢুকে যেতে হয় ঝুঁকি নিয়ে হলেও। সেক্ষেত্রে যদি ভেতরে কোনো মরণাস্ত্র আছে, বা জীবনবিনাশ লাইফ থ্রেট কোনো কিছু আছে এটা যদি আমাদের বলে তাহলে সুবিধা হয় এবং লোকজনের ক্ষতি হয় না। আরেকটি বিষয় হলো কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে সেই প্রতিষ্ঠান এবং তার আশপাশের প্রতিষ্ঠান যাদের পানি আছে তারা পানি ব্যবহার করতে আমাদেরকে দিতে বাধ্য। এটি আইনে বাধ্য-বাধকতা বলা আছে তারা মানা করতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হলো পানি যদি না থাকে তাহলে কীভাবে দিবে? যেমন চট্টগ্রামে আমাদের পানি নিতে বাধা দিয়েছে। আমাদের দেশে আমি এই মুহূর্তে মনে করি, রাস্তা দিয়ে স্ট্রিট হাই-ড্রেন করা প্রয়োজন যেন কোনো বাসার ওপর আমার নির্ভর করতে না হয়। প্রত্যেকটা রাস্তায় যদি হাই-ড্রেন পয়েন্ট থাকে তাহলে সেই পয়েন্ট দিয়ে অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহার করা যাবে। মানুষের জীবন এবং সম্পদ রক্ষার জন্য অগ্নিনির্বাপণ অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে এই হাই-ড্রেন ব্যবস্থাপনার একটা চিন্তা-ভাবনা করা দরকার।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে যদি ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকতো, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা হতো না। এমন কোনো ব্যবস্থা আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে এখানে এ ধরনের সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি। কার্গো ভিলেজের কাস্টমস হাউসের অংশে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ভবনটি বিভিন্ন ছোট ছোট কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা ছিল এবং ভেতরে প্রচুর দাহ্য (কম্বাসেবল) ও হ্যাজার্ডাস উপাদান ছিল। এ জন্য অকুপেন্সি লোড অনেক বেশি ছিল এবং এ কারণেই আগুন নির্বাপণে অনেক বেশি সময় লেগেছে। তিনি বলেন, ভবনটি স্টিল স্ট্রাকচারের তৈরি। এসব ধাতব অংশ আগুনের তাপ শোষণ করে রেখেছিল, এখনো তা ধীরে ধীরে তাপ ছাড়ছে। ভবনের স্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগুনের উচ্চ তাপমাত্রায় কিছু কলামে ফাটল ধরেছে, ভবন কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আমরা কাজ করেছি বলে বুঝতে পারছি এটি এখনো আংশিক স্থিতিশীল। তবু কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কাঠামোগত জরিপ করে ঝুঁকি নিরূপণ করা।