Image description

‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ নামে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটির মালিক কাগজপত্রে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। কিন্তু আদতে এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। শাজাহান খানের দাপটে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নদী-খাল, সরকারি খাস জমি এবং সাধারণ মানুষের জমি দখল করে এই অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে। জেলা প্রশাসন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, এমনকি দুদকের প্রতিবেদনেও এই প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া অর্থাৎ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের জন্য মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হয়েছে দফায় দফায়। এমনকি নদী রক্ষা কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও থ্রি-এঙ্গেল মেরিনের অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।
থ্রি এঙ্গেল মেরিনের মালিক হিসেবে কাগজপত্রে যার নাম আছে, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মুন্সীগঞ্জ, গজারিয়ার মানুষ ইতিপূর্বে শাজাহান খানের ‘শ্যালক’ হিসেবে জানতেন। আওয়ামী লীগ আমলে শাজাহান খানের দাপটের কারণে ‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ এর অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবস্থা নিতে পারছিলো না। মুন্সীগঞ্জ এলাকার মানুষ- যাদের জমি-জমা এই প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ দখলের মধ্যে পড়েছে তারাও ভয়ে কিছু বলতে পারেনি আওয়ামী লীগ আমলে। কিন্তু, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের বেনামী এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুন্সীগঞ্জ, গজারিয়ার মানুষ। ফ্যাসিস্ট মন্ত্রী শাজাহান খানের অবৈধ প্রতিষ্ঠান এখনো কীভাবে এতটা ক্ষমতাবান হয়, এ প্রশ্ন তুলছেন তারা।

যেভাবে গড়ে উঠেছে থ্রি এঙ্গেল মেরিন
২০১১ সালে নয়ানগর মৌজায় মেঘনার কূলঘেঁষে কিছু জমি কিনে যাত্রা করে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড-এর কারখানা। তখন থেকেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। মেঘনা নদী, ফুলদী নদী, কুমারিয়া খাল, বুরুরচক খাল, মালিকানার কৃষিজমি, সরকারের খাসজমি সবই ঢুকে যেতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির পেটে।
এক দশক আগেও সবুজ ক্ষেত আর ফল-ফসলে সমৃদ্ধ ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার দ্বীপসদৃশ উপজেলা গজারিয়ার নয়ানগর মৌজার সদর ইউনিয়ন। তিন ফসলি জমিগুলোতে ফলত ধান, আলু, ভুট্টা। বর্ষায় পাওয়া যেত প্রচুর মাছ। বছরে শত শত কোটি টাকার ফসলই ছিল সেখানকার কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস। সেই সবুজ মাঠ আর কৃষিজমি এখন যেন ধু-ধু মরুভূমি। ২০১১ সালের স্যাটেলাইট চিত্রে যে ভূখণ্ডটি নদীর পানি আর সবুজ গাছগাছালিতে ছিল পরিপূর্ণ, পরের বছরগুলোতে সেখানে বাড়তে থাকে বালুভূমি। বালুতে ভরে ওঠে নদী, খাল। চাপা পড়ে যায় উর্বর কৃষিজমি। সেখানে গড়ে ওঠে ‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ নামের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি। রুদ্ধ হয়ে যায় শত শত কৃষকের জীবিকার পথ।
এলাকা ঘুরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নদী, খাল, বিল ও কৃষিজমি ভরাট করে দখল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ও তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন, জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য চিঠিও দিয়েছে। কিন্তু নদী, খাল, জমি দখলমুক্ত হয়নি।

নদী রক্ষা কমিশনের তদন্ত ও পদক্ষেপ
২০১৯ সালে ৬ মে অবৈধভাবে নদ-নদী খাল, বিল ও জলাশয় দখল করে রাখা শীর্ষ ৫০ দখলদারের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন। প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে শীর্ষ দখলদার হিসেবে নাম আসে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের। পরে তালিকাটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়। নদী রক্ষা কমিশনের তদন্তেও নদ-নদী, খাল ও কৃষিজমি দখলের প্রমাণ পাওয়া যায়।

থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড অবৈধভাবে নদ-নদী ও খালের যেসব জায়গা দখল করে রেখেছে, সেগুলো উদ্ধার করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি উচ্চতর তদন্ত করতে নদী রক্ষা কমিশনকেও নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিশন তদন্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে চিঠিও দেয়া হয়েছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে নদী দখলদার হিসেবে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের বিষয়ে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি মেঘনার তীর থেকে প্রায় ৫০০ ফুট ভেতরে এবং ফুলদী নদীর মাঝ বরাবর দখল করে নিয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ও নদীর জমি দখলমুক্ত করতে প্রতিষ্ঠানটি সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নদী, খাল, কৃষি ও অকৃষি খাসজমি দখল ও অবৈধভাবে ভরাটের বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর পৃথক তদন্তে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৪ একর জলাশয়, খাল, নদী ও কৃষিজমি দখলের কথা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ফুলদী নদীর তীর ভরাট করে ৬০ একর, সরকারের ৩০ একর খাসজমি, মেঘনা নদীর তীর ভরাট করে ৬০ একর, কুমারিয়া খাল ভরাট করে ১০ একর, গোপাট দখল করে ৪ একর, বুরুর চক খাল ভরাট এবং গজারিয়ার আরও দুটি মৌজায় প্রায় ১১০ একর জায়গা।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সচিব (যুগ্মসচিব) মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার ফোনে জানিয়েছেন, কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে থ্রি এঙ্গেল মেরিনকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি এখানে পদায়ন পেয়েছেন গত মে মাসে। সম্প্রতি তাঁর হাত দিয়েও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হয়েছে অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য। এর আগে তো বেশ কয়েকবার চিঠি পাঠানো হয়েছেই।

দুদকের তদন্তেও নদী, খাল এবং জমি দখলের প্রমাণ মিলেছে
নিজের জমি ফিরে পেতে গত এক দশক ধরে দেনদরবার ও অভিযোগ করে এলেও প্রতিকার মেলেনি। কেউ কেউ আদালতের কাঠগড়ায় ঘুরছেন বছরের পর বছর ধরে। পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধারে নেমে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক কৃষক। একটি অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। দুদকের একটি টিম ইতিপূর্বে সরেজমিনে বিষয়টি তদন্ত করে। তাদের তদন্তেও থ্রি এঙ্গেলের বিরুদ্ধে দুটি খাল ভরাট ও জমি দখলের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এদিকে পরিবেশ দূষণের দায়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড-এর এক কর্মকর্তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তিনি হলেন এম এ রহমান আনসার। এম এ রহমান থ্রি এঙ্গেলের ডিরেক্টর (লজিস্টিক) পদে আছেন।
শীর্ষনিউজ