
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নিজেরা বিভক্ত হয়ে গেলে, ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হয়ে গেলাম।
তিনি বলেন, আমরা ঐক্যের কথা বলি। যে ঐক্যের কথা আমরা বলি সেই ঐক্য দুর্গাপূজার কাঠামোর মধ্যেই আছে। লক্ষ্মীর ধনসম্পদ, সরস্বতীর জ্ঞান কার্তিকের বীরত্ব গণেশের সাফল্য দশভূজা দুর্গার অসীম শক্তি সম্মিলিতভাবে সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে। এরমধ্যেই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিত্র আছে। জ্ঞান নিয়ে, সম্পদ নিয়ে, শক্তি নিয়ে সবাই যার যার শক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা সব অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে পারব। এর থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করার কারও সাধ্য নেই।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা সে যে ঘরেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন। সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক। সবাই নাগরিকের সমান সুবিধা পাবে। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার শক্তি তাদের আছে। তারা কেউ বন্দি থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। কারো ভয়ে পালিয়ে থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। আমরা তাদেরকে সেই সুযোগ দিতে চাই। তারা নিজের মত করে গড়ে উঠবে। দেশকে গড়ে তুলবে। পৃথিবীকে গড়ে তুলবে।
তিনি বলেন, আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হতে চাই না। আমাদের তরুণরা জেগেছে, আমাদের মানুষ জেগেছে। আমরা নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি। সেটাই নিশ্চিত করতে চাই। তা না হলে এত রক্তপাতের, এত আত্মত্যাগের কি ফল পেলাম? আমাদের ছেলে-মেয়েরা ২৪ জুলাই যে অসাধ্য সাধন করেছে, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ করা। এখানে সব নাগরিক সমান সুযোগ পাবে।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা এমন রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, পৃথিবী আমাদেরকে অনুসরণ করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বৈষম্য, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার যে অগ্রযাত্রা শুরু করেছি, তার সব বাস্তবায়ন করতে হলে ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সব অশুভ, অন্যায়, অন্ধকারকে পরাজিত করে ঐক্য সম্প্রীতির জয় হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। পুরো জাতি একটি পরিবার। পরিবারের ভেতরে মতভেদ থাকতে পারে, ব্যবহারের পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু পরিবার একটি অটুট জিনিস—এটাকে কেউ ভাঙতে পারবে না। আমরা যেন জাতি হিসেবে এই অটুট পরিবার হয়ে দাঁড়াতে পারি, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, যত ধর্মীয় পার্থক্য থাকুক, মতের পার্থক্য থাকুক, রাষ্ট্রের কোনো অধিকার নেই বৈষম্য করার। রাষ্ট্র দায়িত্ববদ্ধ সবাইকে সমান মর্যাদা দেওয়ার জন্য। সে যেই ধর্মেই বিশ্বাস করুক, যে মতবাদেই বিশ্বাস করুক, ধনী হোক কিংবা গরিব—রাষ্ট্রের কাছে সে একজন নাগরিক। নাগরিকের সকল অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, রাষ্ট্র আমাদের তালিকা করে দিয়েছে আমার প্রাপ্য কী। কোনো সরকারের অধিকার নেই কাউকে বঞ্চিত করার, সামান্যতম পরিমাণেও নয়। আমরা নাগরিক—আমাদের প্রতি কোনো রকম বৈষম্য করা যাবে না। এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সবসময় সোচ্চার থাকতে হবে।
নাগরিক অধিকার প্রসঙ্গে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যত কথাই বলুন, তার মধ্যে বারে বারে বলুন—আমি এ দেশের নাগরিক, আমার সংবিধান প্রদত্ত সকল অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তখন দেখবেন সবাই আপনাদের সঙ্গী হবে। সারা দেশের মানুষ একসঙ্গে থাকবে, কারণ সবার সমস্যাই একই—নিজের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।’
তিনি আরও বলেন, আমরা বারবার লাঞ্ছিত হই, অপমানিত হই, নানা বৈষম্যের শিকার হই। কেন? কারণ নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে আমরা হতাশ হয়ে গেছি। এখন আর হতাশ হওয়া চলবে না। নতুন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো—সবার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা।
নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যে আমাদের ধর্ম পালন করতে চাই না জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমরা নাগরিক হিসেবে মুক্তভাবে, যার যার ধর্ম পালন করতে চাই। এই অধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা পালন করার জন্য তাদের সবার প্রতি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমাদের এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষের ধর্মীয় উৎসব পালনে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপের প্রয়োজন হবে না।