Image description

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ছে। কখনো উড়োজাহাজের চাকা খুলে পড়ছে, আবার কখনো চাকা ফেটে যাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে চাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় গ্রাউন্ডেড রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে চুরি হয়ে যাচ্ছে বিমানের উড়োজাহাজের চাকা। খোদ বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সদস্যরাই মূল্যবান এই চাকা চুরির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় বিমান বন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছে গত সোমবার। করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। শাহজালাল বিমান বন্দরের অভ্যন্তরে হাই সিকিউরিটি এলাকা থেকে চাকা চুরির ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার বিমানের সহকারী ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মোশারেফ হোসেন বিমানবন্দর থানায় এ জিডি করেন।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সটির কর্মকর্তারা বলছেন, ‘চাকা চুরির’ ঘটনায় তদন্ত শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি বিমানের উড়োজাহাজগুলো কয়েকবার বিকল হয়। এসব ঘটনায় বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই চাকা চুরির অভিযোগ সামনে এল।

বিমানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, একেকটি চাকার দাম পাঁচ থেকে ১৫ হাজার ডলার। সেই হিসেবে প্রায় কোটি টাকার চাকা বেচে দিয়েছেন বিমানের কর্মীরাই।
চাকাগুলো ব্যবহৃত জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো হ্যাঙ্গারের পাশে ‘অকশন শেডে’ রাখা ছিল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে বিমান।

‘চাকা চুরি’র বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার বিমানবন্দর থানায় করা জিডিতে বিষয়টিকে চুরি হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে বাদী বিমানের কর্মকর্তা মোশারেফ লিখেছেন, গত শনিবার (১৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০টি ‘আনসার্ভিসেবল টায়ার’ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সের পাশের অকশন শেডে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জিডিতে বলা হয়, খুঁজে না পাওয়ার পর বিমানের ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট সুপারভাইজার আরমান হোসেন ও স্টোর হেলপার সামসুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সে কর্মরত (এজিএম) শফিকুল ইসলামকে ১০টি চাকা ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। আর এটি ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষকে’ না জানিয়ে করা হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার বলছেন, উড়োজাহাজের চাকার বিষয়ে বিমানের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে। পুলিশ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সম্প্রতি এক মাসের মধ্যে অন্তত আটবার বিমানের বোয়িং উড়োজাহাজগুলোতে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়, তাতে বিমানের শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। এই গোলযোগের মধ্যে চাকা ফাটার ঘটনাও রয়েছে। এসব গোলযোগে বাতিল করতে হয় কয়েকটি ফ্লাইট, বিলম্ব হয় অনেকগুলো ফ্লাইট। এই ঘটনাগুলো আলোচনায় আসার পর মঙ্গলবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিমান এসব ঘটনায় ‘তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি’ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানায়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, “বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রীসুরক্ষা ও সেবার মান বজায় রাখাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করছে।”

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিমানের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইতোমধ্যে ঢাকা–আবুধাবি ফ্লাইটে টয়লেটের ফ্লাশ সম্পর্কিত ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গেল ১ জুলাই হতে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কারিগরি সমস্যাগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটি প্রতিটি ফ্লাইটভিত্তিক ঘটনার রক্ষণাবেক্ষণ রেকর্ড এবং ‘অপারেশনাল প্রসেস’ পর্যালোচনা করে ঘটনার মূল কারণ নির্ধারণ এবং কারিগরি সমস্যাগুলোর বিপরীতে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবহেলা বা গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে তার দায়-দায়িত্ব চিহ্নিত করবে।

একই সঙ্গে এ ধরনের সমস্যার পুনরাবৃত্তি রোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ দেবে কমিটি। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি তার প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে বিমানের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের’ অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিমানের জনবল ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। দুইজন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে এবং আরও কয়েকজনকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় একজন প্রকৌশলী কর্মকর্তাকে ‘শাস্তিমূলক’ বদলি করা হয়েছে এবং চট্টগ্রামে অন্য একজন প্রকৌশলী কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার কথা বলেছে বিমান।

কারিগরি সক্ষমতা বাড়াতে বিমান বিভিন্ন আউটস্টেশনে (যেমন জেদ্দা, দুবাই, মদিনা, দাম্মাম, আবুধাবি ও শারজাহ) অতিরিক্ত চাকা মজুদ রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে আপৎকালীন প্রয়োজনে দ্রুত চাকা প্রতিস্থাপন করা যায়। সেজন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় চাকা সংগ্রহের ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে।

জেদ্দায় বিমানের চাকা ফেটে যাওয়ার ঘটনা তদন্তে ফ্লাইট অপারেশনস পরিচালককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রকৌশল ও ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক এবং প্রধান প্রকৌশলীদের সরাসরি তত্ত্বাবধান জোরদার করার কথাও বিমান বলেছে।

গত ১৮ আগস্ট থেকে রাত্রিকালীন বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ শিফট চালু হয়েছে, যা সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে সহায়তা করবে।
একই সঙ্গে বিমানের ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা চলছে। এ প্রক্রিয়ায় বোয়িংয়ের সঙ্গে আলোচনা করে কম্পোনেন্ট সার্ভিসেস প্রোগ্রাম (সিএসপি) তালিকা পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।

পাশাপাশি, রেকোমেন্ডেড স্পেয়ার পার্টস লিস্ট (আরএসপিএল) অনুসারে যন্ত্রাংশের মজুদ নতুনভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। প্রকৃত ব্যবহারিক তথ্যের ভিত্তিতে যন্ত্রাংশ সংগ্রহের জন্য টেইলরড পার্ট প্যাকেজ (টিপিপি) ব্যবস্থা পর্যালোচনায় রয়েছে বলেও বিমানের ভাষ্য।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি বিমানের প্রকৌশলীদের ‘রি-কারেন্ট’ প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন শিক্ষানবিশ মেকানিক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রযুক্তিগত জনবল বাড়ানো এবং নিজস্ব দক্ষতা আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিমান।

শীর্ষনিউজ