
সরকারি প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ে নানা ধাপে অনিয়ম - দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ নতুন নয় । এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ হয় , বেড়ে যায় প্রকল্পের ব্যয় । এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পথ খুঁজছে অন্তর্বর্তী সরকার । এ লক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলনকক্ষে উচ্চপর্যায়ের এক কর্মশালার আয়োজন করে সরকার । সাড়ে চার ঘণ্টা চলা ওই কর্মশালায় প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে । সমস্যা সমাধানে উঠে এসেছে একগুচ্ছ সুপারিশ । মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় সরকারের উপদেষ্টাগণ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী , সিনিয়র সচিব, সচিব এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন ।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ কর্মশালায় চালকের ভূমিকায় ছিলেন । কর্মশালা শেষে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি । তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে , কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা সুনির্দিষ্ট প্রকল্প নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা শেষ করার ওপর জোর দিয়েছেন । যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পুল গঠনসহ সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছেন তাঁরা ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ গতকাল সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কর্মশালায় প্রকল্পবিষয়ক নিয়মকানুনগুলো সম্পর্কে সবাইকে জানানো হয়েছে । যার যতটুকু কনফিউশন বা সমস্যা ছিল , সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে । উপদেষ্টাসহ কর্মশালায় অংশ নেওয়া সবাই তাঁদের মতামত দিয়েছেন । প্রকল্প ব্যবস্থাপনা আরও স্মুথ ও স্মার্ট হোক , আমরা সবাই এটা চেয়েছি । এ জন্য এ বিষয়ে যেসব পয়েন্ট উঠে এসেছে , সেসব পয়েন্টের ওপর সবাই কথা বলেছেন । ' অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে । অনেক প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে । কিছু প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে ।
সূত্র জানায় , ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৫৪ টি । এসব প্রকল্পের মধ্যে ৬৬৮ টি প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে । নিবিড় পরিবীক্ষণ করা হয়েছে ৫৫ টি , আর প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে ২১ টির ।
গতকালের কর্মশালায় প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের কোন কোন পর্যায়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা সুবিধা নেওয়ার সুযোগ পান , সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় । রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া কোনো প্রকল্প অনুমোদনপ্রক্রিয়ায় কর্মকর্তারা আইন - বিধি অনুযায়ী কেন আপত্তি জানান না , সেসব নিয়েও কথা হয়েছে । উপদেষ্টারা ও বিশেষ সহকারীরা এ বিষয়ে তাঁদের মতামত দিয়েছেন । আইন ও বিধিতে কোনো ফাঁক থাকলে সেগুলো দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা । অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কেউ কেউ একসঙ্গে চারটি পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন । কোনো কোনো কর্মকর্তা দুটি , কেউ কেউ তিনটি পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন । সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোর সঙ্গে তাঁদের কাজের তেমন অভিজ্ঞতা নেই । ফলে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে প্রকল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে কীভাবে তদারক করতে হয় , সে বিষয়ে কর্মশালায় তাঁদের সার্বিক ধারণা দেওয়া হয়েছে ।
কর্মশালায় অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা জানান , বড় প্রকল্পগুলোতে অনিয়ম - দুর্নীতি করতে অনেক সময় পছন্দের ব্যক্তিকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় । যেকোনো কর্মকর্তাকে চাইলেই যাতে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে না পারে , কর্মশালায় সেই পথ বন্ধ করার সুপারিশ এসেছে । এ জন্য যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে পিডি পুল পুলভুক্তদের ফিন্যান্সিয়াল প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজমেন্ট , ম্যানেজমেন্ট এবং প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট - বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থার সুপারিশ এসেছে । চিহ্নিত হয়েছে যেসব সমস্যা প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি সমস্যার কথা প্রায় শোনা যায় , তা হলো যথাযথ সম্ভাব্যতার সমীক্ষা না করেই প্রকল্প গ্রহণ । গতকালের কর্মশালাতেও এই সমস্যাটি উঠে এসেছে । অংশীদারদের পরামর্শ না থাকা , ভৌত কাজের যথাযথ এবং স্ট্রাকচারাল ডিজাইন না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে সমস্যা দেখা দেয় বলে এতে জানানো হয় ।
এ ছাড়া প্রকল্পের সঠিক লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন না করা , প্রকল্প প্রাক্কলনে অযৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণ , পরিবেশগত বিষয় বিবেচনায় না নেওয়া , মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ না করা , পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । চিহ্নিত হওয়া অন্য সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না করা , একই ব্যক্তির একাধিক প্রকল্পে দায়িত্ব পালন , অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না করা , ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি , ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস শিফটিং - সংক্রান্ত সমন্বয়হীনতা , প্রকল্পের এক্সটার্নাল অডিট নিয়মিত না হওয়া এবং বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সম্মতি পেতে দেরি হওয়া ।
এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বীকৃত মডেল ব্যবহার না করা , পিইসি বা ডিপিইসির সভায় আইএমইডির প্রতিনিধির মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত না হওয়া ; প্রকল্পের ওয়ার্কপ্ল্যান এবং প্রকিউরমেন্ট যথাযথভাবে প্ৰণয়ন, সঠিকভাবে অনুসরণ ও মনিটরিং না করাকেও সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । এর বাইরে ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব যথাসময়ে না পাওয়া , আইএমইডির ই- পিএমআইএস সফটওয়্যারে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সব তথ্য যথাসময়ে আপলোড না করা , যথাসময়ে প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন আইএমইডিতে দাখিল না করা , সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় সৃষ্ট অবকাঠামো ও সংগৃহীত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে সংরক্ষণ , রক্ষণাবেক্ষণ না করা , প্রকল্পবিশেষ জনবলের সংস্থান না থাকা এবং যথাসময়ে জনবল নিয়োগ না করাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধানে বেশ কিছু সুপারিশও উঠে এসেছে গতকালের উচ্চপর্যায়ের কর্মশালায় । বাস্তুগত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা ; মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণবিষয়ক ড্রয়িং ডিজাইন করা ; সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করে যুক্তিসংগতভাবে প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট কম্পোনেন্ট রাখা , প্রস্তাবিত প্রকল্প দলিলের সংযোজনীতে কী প্রক্রিয়ায় মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে , তা তুলে ধরার সুপারিশ করা হয় ।
প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগে সংস্থা কর্তৃক যথাসময়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ এসেছে । ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস শিফটিং - সংক্রান্ত পৃথক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে । প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা এবং সেসব সমাধানের আলোচনা- পর্যালোচনার পর কর্মশালায় প্রকল্প নেওয়ার আগে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা বিভাগের গাইডলাইন মোতাবেক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে । প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত পরিপত্র অনুযায়ী পরিচালক নিয়োগ, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পিডি পুল গঠন করা এবং পুলভুক্ত কর্মকর্তাদের ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট-বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রকল্প বাস্তবায়নে নিবিড় মনিটর নিশ্চিত করা ; আইএমইডির ই- পিএমআইএস সফটওয়্যারে প্রকল্পের তথ্য হালনাগাদ নিশ্চিত করা ; প্রকল্পের পিএলসি ও পিআইসি সভা করা ও সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মনিটরিং করা এবং প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টেকসইকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো এবং জনবল নিয়োগের বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুপারিশ উঠে এসেছে কর্মশালায় ।
এতে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন , উচ্চপর্যায়ের কর্মশালা থেকে যেসব সুপারিশ এসেছে , অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে । এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এবং সহযোগিতা নেওয়া হবে । প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধানে কোন কোন সরকারি দপ্তরকে কী কী কাজ করতে হবে , সেগুলো নির্ধারণ করে দিয়ে দ্রুত তা সমাধানের নির্দেশনা দেওয়া হবে ।