
ঢাকা থেকে সিলেটে সড়কপথে যেতে স্বাভাবিক অবস্থায় সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। কিন্তু এখন এই সড়কে যাত্রীদের কাটাতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। এই মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ চলা এবং ভৈরব থেকে সরাইলের বিশ্বরোড অংশে আগেই শুরু হওয়া চার লেন প্রকল্পের কাজের হ-য-ব-র-ল অবস্থার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ভৈরব থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার সড়ক পার হতেই যাত্রীদের ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। কোনো কোনো দিন এর চেয়েও বেশি সময় লাগছে। এ অবস্থায় এই ঢাকা থেকে সিলেটসহ অন্যান্য জেলার যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া সিলেট হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার উৎপাদনও বড় ঝুঁকিতে পড়ছে। পচনশীল পণ্য পরিবহনও জটিল হয়ে উঠেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। সড়ক পথে এই দুর্ভোগের কারণে বিকল্প হিসেবে অনেকে ট্রেনে যাতায়াত করছেন। কিন্তু ট্রেনের সংখ্যা এবং আসন না থাকায় অনেকে দাঁড়িয়ে আট থেকে নয় ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিচ্ছেন।
ঢাকা থেকে হবিগঞ্জগামী যাত্রী সাইফুর রহমান বলেন, জরুরি কাজে রাত ১২টায় মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল ভোরে সেখানে পৌঁছে জরুরি কাজ সেরে বিকালে আবার ঢাকা ফিরবেন। পথের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, রাত তিনটায় নরসিংদীর বারৈচা পৌঁছার পর যানজটে পড়েন। এই যানজট ঠেলে ভৈরব ব্রিজে পৌঁছান সকাল সাতটায়। এখানেই শেষ নয়। ভৈরব থেকে সরাইলের বিশ্বরোড মোড়ে পৌঁছাতে লাগে আরও চার ঘণ্টা। তখনও দীর্ঘ যানজট লেগে থাকায় বিকল্প হিসেবে সরাইল-নাসিরনগর সড়ক হয়ে তিনি হবিগঞ্জ পৌঁছান বেলা দুইটায়। তিনি বলেন, যানজটের কারণে নির্ধারিত কাজ করতে পারেননি।
একই ধরনের বর্ণনা দেন সিলেট থেকে ঢাকায় আসা যাত্রী ইকরামুল। ব্যবসার কাজে তিনি নিয়মিত ঢাকা আসা-যাওয়া করেন। তিনি বলেন, ভোরে সিলেট থেকে রওনা দিয়ে সকাল ১০ টার দিকে মাধবপুর পৌঁছান। এরপর শুরু হয় যানজট। এই যানজট ঠেলে ভৈরব পর্যন্ত যেতে বেলা দুইটা হয়ে যায়। বাকি রাস্তা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে যায়। তিনি বলেন, এটি এই সড়কে এখন নিয়মিত ঘটনা। সড়কের দুর্ভোগ এড়াতে রেলে যাওয়ার চেষ্টা করলেও আসন পাওয়া যায় না। ট্রেনের সংখ্যা বাড়ালে হয়তো মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো।
এই মহাসড়কে যাতায়াতকারী যাত্রীরা জানিয়েছেন, প্রবাসগামী যাত্রীদের হাতে আট থেকে ১০ ঘণ্টা বেশি সময় নিয়ে বের হতে হচ্ছে। যারা বাড়তি সময় নিয়ে বের হন না তাদের অনেকে ফ্লাইটও মিস করছেন যানজটে আটকে থেকে। রোগীদের নিয়ে এই সড়কে যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সরজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ গোলচত্বর ও সরাইল বিশ্বরোডের মোড় পর্যন্ত সড়ক এখন পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই পয়েন্টে সৃষ্ট যানজটে স্থবির হয়ে পড়ছে মহাসড়ক। ২০/২২ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লেগে যাচ্ছে কয়েক ঘণ্টা। এটি রোজকার চিত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়া খাটিহাতা হাইওয়ে থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা হয় মঙ্গলবার দুপুরের পর। যানজট সারাতে ব্যতিব্যস্ত এই কর্মকর্তা জানান- ‘যানজট আছে দু’-দিকেই, ঢাকা ও সিলেটগামী। আশুগঞ্জের দিকে ৪/৫ কিলোমিটার। এদিক দিয়ে ৩/৪ কিলোমিটার। দু’টো গাড়ি সমান সমান ক্রস করতে পারে না। রাস্তা ভাঙা। একদিকের গাড়ি গেলে আরেক দিকের বন্ধ থাকে। প্রতিদিন, ২৪ ঘণ্টাই এ অবস্থা। গোলচত্বর থেকে ৩ দিক, সিলেটের দিকে এক দেড় কিলোমিটার, ঢাকার দিকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রাস্তা ভাঙাচুরা। একটা গাড়ি পড়লে আর উঠতে পারে না। এখনই ২/৩টি গাড়ি রেকার করলাম। ভাঙার জন্যে কেউ কিছু করে না। বলেও না। মেরামত করে না। এই অবস্থা চলতে পারে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত মোট ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর ৩ বছর পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয় লেন করার কাজ শুরু হয়। চারলেন প্রকল্প সূত্র জানায়, তখন তাদের প্রকল্পের আওতাধীন আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার অংশ ছয় লেনের আদলে করার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। সেজন্য রাস্তার ডিজাইনে পরিবর্তন আসে। ফোর লেনের মূল ডিজাইনে সার্ভিস লেনে ছিল ১২ ফুট রাস্তা এবং এটি মূল রাস্তা থেকে ২ ফুট নিচে ছিল। পরবর্তীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে একই রকম করতে ১৮ ফুট করা হয় এবং সার্ভিস লেনের লেবেলও সমান করা হয়। তাছাড়া বিএডিসি’র ক্যানেল চালু রাখার জন্যে ৫ কিলোমিটার পাকা ক্যানেল করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় এই প্রকল্প থেকে। এজন্য সবমিলিয়ে খরচ বাড়ে ১৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু বাড়তি কাজের অনুমোদন দেয়া হয়নি এখনো। সে কারণে প্রকল্পের ওই অংশ কাজ এগোয়নি। কাজ বন্ধ ছিল একবছর। ফলে দিনে দিনে রাস্তা বেহাল হয়ে দুর্ভোগ উঠেছে চরমে। এদিকে পুরো প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে এ বছরের জুনে। প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর বৃদ্ধির প্রস্তাবও অনুমোদন হয়নি। এই দুই কারণে স্থবির এখন প্রকল্পের কাজ।
ভারতীয় ঋণ সহায়তা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকায় ৩টি প্যাকেজে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদার নিযুক্ত হয় ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। শুরু থেকে নানা জটিলতায় পিছিয়ে যায় প্রকল্পের কাজ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই সড়ক নির্মাণকাজ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের ১০ই আগস্ট ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চলে যান নিজের দেশে। কয়েক মাস পর তারা ফিরলেও কাজ চলতে থাকে ঢিমেতালে। এমন অবস্থায় গত মার্চে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সভায় প্রকল্পের ৩টি প্যাকেজের মধ্যে ৩ নম্বর প্যাকেজ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই প্যাকেজে তন্তর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার চারলেন সড়কের কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন আশুগঞ্জ থেকে সরাইল মোড় পর্যন্ত ১ নম্বর এবং সরাইল বিশ্বরোড মোড় থেকে আখাউড়া তন্তর পর্যন্ত ২ নম্বর প্যাকেজের কাজ চলছে। এই অংশের ২৭ কিলোমিটার কাজেরও অগ্রগতি অর্ধেকের বেশি নয়। ফলে এ পথে সিলেট, ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা যাতায়াতও কঠিন হয়ে পড়েছে। শহর বাইপাস সড়কের বিরাশার, পৈরতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে পুনিয়াউট, রাধিকা, সুলতানপুর, উজানিসার থেকে তন্তর পর্যন্ত সাড়ে ৭ কিলোমিটার সড়ক খানাখন্দে বেহাল। যানবাহন ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে ১ নম্বর প্যাকেজে অতিরিক্ত কাজের ব্যয়সহ ৭৩৭ কোটি এবং ২য় প্যাকেজে ১৮৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা আছে।
আশুগঞ্জ নৌবন্দর-আখাউড়া স্থলবন্দর ফোরলেন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. শামীম আহমেদ জানান, গত ২০ দিন আগে আশুগঞ্জ ও সরাইল মোড়ে প্রকল্পের ডিজাইন অনুসারে কাজ শুরু হয়েছে। ট্রাফিক জ্যামের কথা যদি বলি প্রকল্পের যে খারাপ অংশ আছে সেগুলো আমরা বারবার রিপেয়ার করছি। আসলে এতো ভারী যানবাহন চলাচল করে এতে সড়কের যে ভিত্তি ছিল এটি নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টি হলে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ কোনোভাবেই টেকানো যাচ্ছে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি কখনো ইট, কখনো পাথর ফেলে চলাচল ঠিক রাখতে। জাতীয় মহাসড়ক বলে এতে অত্যন্ত ভারী যানবাহন চলে। ফলস্বরূপ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাস্তা খারাপ- অবশ্যই এটা একটা ফ্যাক্টর। সেইসঙ্গে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট যেটা হচ্ছে বিশ্বরোডে দেখবেন বাসগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু মিলিয়ে এখানে যানজট। প্রকল্পের সমস্যাগুলো দূর হয়ে গেলে তাহলে কাজ আর বন্ধ হবে না। অতিদ্রুতই এক-দেড়মাসের মধ্যে সরাইলের অংশ ছেড়ে দিতে পারবো। আশুগঞ্জেও কাজ শুরু হয়েছে। সামনে আর এই সমস্যা থাকবে না।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই এলাকায় যানজটের বড় কারণ স্থানীয় যানবাহনের ভিড়। সিএনজি অটোরিকসা, শিশুক, রিকশাসহ ছোট যান এই সড়ক দিয়ে অবাধে যাতায়াত করছে। এতে যানজটে আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন- বিষয়টি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অবহিত রয়েছেন। এটি যেহেতু প্রজেক্টের কাজ আমার তরফ থেকে আমি পুরো বিষয়টি মনিটর করি। আমি আশা করি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খুব অল্প সময়ে যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে কাজটি এগিয়ে যাবে সে ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেবেন। আগামীকাল (আজ বুধবার) ও পরশু একটা মিটিং আছে। আমি মনে করি এই মিটিংগুলোর মাধ্যমে প্রজেক্টের চলমান সমস্যাগুলো সমাধান হলেই এই জনভোগান্তি হ্রাস পাবে। ঠিকাদার প্রস্তুত আছে। তারা দ্রুত কাজগুলো করে ফেলবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন- নানা জটিলতার কারণে ঠিকাদার কাজ করতে পারছেন না। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ভেরিয়েশন এবং প্রকল্পের মেয়াদ অনুমোদন না হওয়া। বিষয়গুলো মন্ত্রণালয় অধীন। আমি নিজেও মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। তারপরও ঠিকাদারকে অনুরোধ করে কাজ করাচ্ছি। বিভিন্ন সময় স্থানীয় ভাবে ১ লাখ ইট সংগ্রহ করে সড়কের খানাখান্দ ভরাট করে যানবাহন চলাচল সচল রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।