Image description
ওষুধের দাম নির্ধারণসহ সার্বিক কার্যক্রম

ওষুধের দাম নির্ধারণসহ এ সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এতদিন ছিল শুভংকরের ফাঁকি। অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধ কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। উপেক্ষিত হয়েছে ক্রেতার স্বার্থ। কারণ, সরকারের এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে থাকা প্রভাবশালী কোম্পানির প্রতিনিধিরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন। অসহায় ক্রেতাদের পকেট থেকে কাটা হতো মোটা অঙ্কের অর্থ। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছর পর ওষুধসংক্রান্ত নানা কমিটি নতুন করে গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেখানে রাখা হয়নি কোম্পানিগুলোর কোনো প্রতিনিধি। সম্প্রতি এসংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানা যায়, এতদিন ওষুধের দাম নির্ধারণ, নতুন ওষুধের নিবন্ধন, ওষুধের নিরাপত্তা-কার্যকারিতা ও ব্যবহার উপযোগিতা নিরূপণ, ওষুধের নিবন্ধন বাতিল বা সাময়িকভাবে স্থগিতকরণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত কমিটিতে থাকতেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি এ ধরনের কমিটিগুলোয় ওষুধ কোম্পানি মালিক বা তাদের প্রতিনিধি থাকা উচিত নয়। কেননা ওষুধের দাম নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা তাদের স্বার্থ দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। এ সরকার যদি তাদের বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি করে, তাহলে সেটি ভালো উদ্যোগ। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন। এতে জনস্বার্থ নিশ্চিতে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে-এ ধরনের কমিটিগুলোয় বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অভিজ্ঞ মানুষকে যুক্ত করা দরকার। যদি অযোগ্যদের কমিটিতে রাখেন, তাহলে তারা তো কমিটিতে রাখার কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই দিন পার করবে। তারা শক্ত ভূমিকা রাখতে পারবে না। ফলে সরকারকে দেখতে হবে কারা যোগ্য, তাদেরই কমিটিতে রাখলে উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে।

অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদানে টাস্কফোর্স, ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ১২ ধারা অনুসারে ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ এবং ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ১২ ধারা অনুসারে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির টেকনিক্যাল সাব-কমিটিসহ নানা ধরনের নতুন কমিটি করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন এসব কমিটি গঠন করে স্বার্থের সংঘাত সম্পর্কিত ঘোষণার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সব সদস্যকে দায়িত্ব গ্রহণের সম্মতি দেওয়ার সময়েই সভাপতি বরাবর ফরমে একটি ঘোষণাপত্র দিতে হবে। সেখানে এই কমিটির কার্যপরিধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে তার কোনো ধরনের স্বার্থ জড়িত নেই মর্মে স্বাক্ষর দিতে হবে। কোনো বিকল্প সদস্যের সভায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ওষুধশিল্প সংক্রান্ত যেসব কমিটি নতুনভাবে গঠন করা হয়েছে, সেগুলো আগের চেয়ে অনেক জনবান্ধব। বাদ দেওয়া হয়েছে কোম্পানিসংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগীদের। কেননা পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিভিন্ন কমিটিতে থাকা সুবিধাভোগীরা শুধু নিজেদের স্বার্থ আদায় করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, তারা তাদের গ্রুপের বাইরের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সব ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকতেন। বর্তমানে এ ধরনের স্বার্থবাদীদের বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটিগুলো সাজানো হয়েছে।

আরও জানা যায়, বাংলাদেশে ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি প্রণয়নের পর প্রথম ২০ বছর ওষুধ প্রশাসনে স্বার্থবাদীদের প্রাধান্য ছিল না। সেখানে ভোক্তাস্বার্থ খুব বেশি উপেক্ষিত হতো না। কিন্তু ২০০২ সালের পর কিছু কিছু কোম্পানির স্বার্থের পক্ষের লোকজন কমিটিতে ঢুকে যায়। পরে ২০০৯ সালের পর থেকে ভোক্তাস্বার্থ প্রকটভাবে উপেক্ষিত হতে থাকে। পতিত সরকারের আমলে ওষুধশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী এক ব্যক্তি ঔষধ প্রশাসন, ওষুধের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ, এমনকি কোন কোম্পানিকে কী পরিমাণ নতুন ওষুধের অনুমোদন দেওয়া হবে-সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। পুরোপুরি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের ব্যাপার থাকলেও তিনি ও তার অনুসারীরা এটি করেছেন বছরের পর বছর। ওষুধ কোম্পানির মালিকরা প্রথমে প্রতিনিধি হয়ে কমিটিগুলোয় ঢুকলেও পরে সমালোচনা হওয়ায় তারা প্রতিনিধির পদবি পরিবর্তন করে পর্যবেক্ষক নাম দিয়ে কমিটিতে থেকে যান। পরে ওই পর্যবেক্ষকরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আগে ওষুধশিল্প থেকে তিন থেকে পাঁচজন সদস্য থাকতেন এবং তারা সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতেন।

নতুন কমিটিতে যারা আছেন : অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদানে টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (ঔষধ প্রশাসন অনুবিভাগ) মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন খানকে। এই কমিটির সদস্যরা হলেন বিএমইউ-এর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ আরাফাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাবির ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাকির আহমেদ চৌধুরী, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শারমিন আব্বাসী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিউল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শর্মিলা হুদাসহ ১৬ জন। এই কমিটিতে ওষুধ কোম্পানি কিংবা ওষুধশিল্প সমিতির কোনো সদস্য নেই।

ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে। সদস্য সচিব হলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এ কমিটি ১৩ সদস্যের। এখানে ওষুধ কোম্পানি কিংবা ওষুধশিল্প সমিতির কোনো সদস্য নেই। এই কমিটিতে বিএমডিসি, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, বিএমএ, বিএমইউ-এর ফার্মাকোলজি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ও ক্লিনিকেল ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রতিনিধি থাকবেন। এছাড়া গঠন করা হয়েছে ২২ সদস্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির টেকনিক্যাল সাব-কমিটি। এর সভাপতি হচ্ছেন বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সদস্য সচিব করা হয়েছে বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসনকে। সদস্যরা হলেন-বিএমইউ-এর উপাচার্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান জেনারেল, আইইডিসিআর-এর পরিচালক, বিএমইউ-এর মেডিসিন অনুষদের ডিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঔষধ প্রশাসন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব, বিএমএ-এর সভাপতি, বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিকেল সোসাইটির সভাপতি।