
ব্যাংক ডাকাতদের দায়ভার চাপছে নিরীহ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘাড়ে। চাকরি ও হয়রানির ভয় দেখিয়ে জালজালিয়াতির ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হতো। ব্যাংক থেকে একমাত্র এস আলমই বের করে নিয়েছেন সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যসহ যাদের সহযোগিতায় তারা অর্থ বের করে নিয়েছে তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু আদালত, দুদকে দৌড়ঝাঁপ করতে দিন পার করতে হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। সারা জীবন সততার সাথে থেকে দায়িত্ব পালন করা অনেকেই মামলার খরচ চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন। এমনই অনেক ভুক্তভোগী কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
জানা গেছে, রাতের অন্ধকারে কিছু ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও ব্যাংকের চেয়ারম্যানদেরকে বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকসহ প্রতিষ্ঠিত কিছু ব্যাংক দখল করেছিল চট্টগ্রামের বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম। দেশের ব্যাংকিং খাতের সব ধরনের সূচকে শীর্ষে অবস্থান করতো ইসলামী ব্যাংক। এক সময় নিচের দিক থেকে প্রায় ২০টি ব্যাংকের সমান বৈদেশিক বাণিজ্য একাই পরিচালনা করতো ব্যাংকটি। কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ একদিন এমডি ও চেয়ারম্যানকে ধরে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটি পুরোপুরি দখলে নেয় এস আলম। দখলের পর থেকে কোনো প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয় এস আলম।
ভুক্তভোগী এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অবৈধভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিতে যারাই বাধা সৃষ্টি করেছে তাদেরকেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা হয়রানি করা হয়েছে। এ জন্য ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে তারই এক সময়ের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন, জেকিউ এম হাবিবুল্লাহসহ কিছু অনুগত কর্মকর্তা। কেউ এস আলমের অবৈধ টাকা বের করায় অসহযোগিতা করলে মিন্টু রোডে ডিবি অফিসে ডেকে নেয়া হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হতো। দেখানো হতো নানা ধরনের ভয়ভীতি। সাথে থাকতো চাকরিচ্যুতের হুমকি। অনেকের কাছ থেকে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখা হতো। এভাবে চাকরি হারানো ও হয়রানির হাত থেকে রক্ষার জন্য অনেকেই এস আলমের অবৈধ টাকা বের করে নেয়ার ভুয়া ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন।
ভুক্তভোগী ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নানাভাবে ব্যাংক খাতের মুরুব্বি বাংলাদেশ ব্যাংককেও এ বিষয়ে অবহিত করা হতো। সবাই জানতেন ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিচ্ছে এস আলম। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করতো না। শেষে ইসলামী ব্যাংকের যখন করুণ অবস্থা, এস আলমের টাকা যোগান দেয়ার মতো সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ইসলামী ব্যাংককে দেয়া হয়। ওই টাকা আবার এস আলম নিয়ে যায়। দায় চাপে ব্যাংকের ওপর। তিনি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টে পরিবর্তিত অবস্থার পর ব্যাংক ডাকাত এস আলম ও তার দোসর আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন দেশ থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু এস আলমের টাকা বের করতে যারা সহযোগিতা করেছিলেন তারা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। কিন্তু চাকরি রক্ষার্থে ও হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পেতে যেসব কর্মকর্তা এস আলমের অবৈধ ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল শুধু তাদেরকেই এখন দায়ভার নিতে হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। দুদকে ডাকা হচ্ছে। দুদকে গেলে বেশির ভাগ মামলারই হাজিরা দিতে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকারদের। অথচ এসব ঘটনার যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্দেশদাতা ছিলেন, তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এভাবে শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফসি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কয়েকশ’ কর্মকর্তা মামলার জালে আটকে আছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। অনেকেই আতঙ্কে দিন পার করছেন। কোন পেক্ষাপটে এস আলম, সালমান এফ রহমান, নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ টাকা পাচারকারীদের ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছিলেন তারা নথি সংগ্রহে অনেকেই ব্যস্ত রয়েছেন।
ভুক্তভোগী আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্টের আগেও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক খেলাপি ঋণের হার দেখানো হতো ৫ শতাংশ, অথচ বাস্তবে ছিল ৯০ শতাংশের ওপরে। ইউনিয়ন ব্যাংকেরও একই অবস্থা। ব্যাংকগুলো সব সংস্থার সামনেই ফোকলা করা হয়েছে, এখন শুধু দায় চাপছে সাধারণ কর্মকর্তাদের ওপর। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সারাজীবন আর্থিক অসততা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অথচ চাপে পড়ে চাকরি রক্ষার জন্য ব্যাংক ডাকাত এস আলমের অবৈধ ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করার অভিযোগে আদালতে ঘুরতে হচ্ছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য। মামলার খরচ চালাতেই এখন তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় শরীরে নানা রোগে বাসা বাঁধছে। এ থেকে তারা পরিত্রাণ চান সরকারের কাছে। তিনি জানান, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদেরকেই আইনের আওতায় আনা হোক। যারা নির্দোষ, চাকরি রক্ষার জন্য স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদেরকে হায়রানি না করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।