Image description
 

প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ দশকে কয়েক দফায় বড় ধরনের চিকিৎসক নিয়োগ হয়েছে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। তবে এসব নিয়োগ কখনো কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হলেও অধিকাংশ সময়ে হয়েছে অনেকটাই গোপনে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়া হয় অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায়। এবারও একই প্রক্রিয়ায় ৬৫ জন চিকিৎসক নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বঞ্চিত চিকিৎসক ও চিকিৎসক নেতারা।

 

চিকিৎসকদের অভিযোগ, হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল হক এবং নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একেএম আজিজুল হক পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেননি। অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞপ্তিতে তড়িঘড়ি করে এসব চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগে কোনো ধরনের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। ফলে যোগ্য চিকিৎসকরা বঞ্চিত হয়েছেন।

 

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঞ্চিত চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দ্বারস্থ হয়েছেন। তাদের দাবি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও শিশু হাসপাতালে মোট ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ বহন করে সরকার। কাজেই যে কোনো নিয়োগ হলে পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়াটাই স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। কিন্তু শিশু হাসপাতালে কোনো নিয়মই মানা হয়নি। নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে প্রতিটি পদে পদে। ফলে এ নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ।

যদিও শিশু হাসপাতালের পরিচালক এবং নিয়োগ কমিটির প্রধানের দাবি, আইন অনুযায়ী পদাধিকার বলে পরিচালক চাইলে অ্যাডহক ভিত্তিতে (অস্থায়ী) নিয়োগ দিতে পারেন। নিয়োগপ্রাপ্তরা সবাই হাসপাতালে কর্মরত অনারারি চিকিৎসক। এ নিয়োগ সম্পূর্ণ অস্থায়ী। প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্যদের মতামত অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক সংকটে ধুঁকছে ৬৮০ শয্যার এই হাসপাতাল। মেডিসিন, সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়াসহ অধিকাংশ বিভাগে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। এমন অবস্থায় চলতি বছরের ১ জুন এসব বিভাগে চুপিসারে ৪২ জন চিকিৎসক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণভাবে প্রকাশিত এই বিজ্ঞপ্তিতে মেডিসিন বিভাগে ২২ জন, সার্জারিতে ১১ জন, অ্যানেসথেসিয়ায় পাঁচজন, নাক, কান ও গলা বিভাগে দুটি এবং ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের দুইজন চিকিৎসক নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ৪২ জনের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরো ২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এজন্য কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, তড়িঘড়ি করে আবেদনের ১৪ দিনের মধ্যে ৬৫ জন চিকিৎসকের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ না করে প্রত্যেককে আলাদা করে চিঠির মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়টি জানানো হয়।

হাসপাতাল পরিচালনা বোর্ডের অন্তত চারজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়নি। সেটি না হওয়ায় অনেকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর এত চিকিৎসক অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়।

তবে এই হাসপাতালে এমন গোপন নিয়োগ এটিই প্রথম নয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালেও এই প্রতিষ্ঠানে ৬০ জন চিকিৎসক অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন প্রশাসন।

এবারও একই প্রক্রিয়া অনুসরণকে জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে প্রতারণা বলে অভিযোগ করেন বঞ্চিত চিকিৎসকরা। তাদের দাবি, এভাবে গোপন নিয়োগের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে।

তবে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল হকের দাবি, তীব্র সংকট দূর করতেই দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি আমার দেশকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিটি বিভাগে চিকিৎসকের তীব্র সংকট ছিল। খালি ছিল ১২১টি পদ। এসব পদে স্থায়ীভাবে নিয়ম মেনে নিয়োগ হলে নানা জটিলতায় অনেক সময় পেরিয়ে যেত। তাই অ্যাডহক ভিত্তিতে ৬৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যেহেতু অস্থায়ী নিয়োগ তাই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রয়োজন না থাকায় অভ্যন্তরীণভাবে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তরা সবাই এ হাসপাতালেই বিনা বেতনে কাজ করতেন।

ডা. মাহবুবুল আরো বলেন, ছয় মাস পর নতুন করে নিয়োগ হবে। স্থায়ীভাবে সে নিয়োগে অ্যাডহকদেরও আবেদন করতে হবে। সেখানে লিখিত ও মৌখিকভাবে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। যেহেতু নিয়োগ বোর্ড তাদের বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে, তাই বলা যায় কোনো অনিয়ম হয়নি।

তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রসঙ্গে পরিচালকের বক্তব্যের বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালনা বোর্ডের ওই চার সদস্যের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, নিয়োগ চূড়ান্তের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠলে তড়িঘড়ি করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করা হয়। হাসপাতালের আইনে অ্যাডহক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। স্বাভাবিক নিয়োগে নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। যেকোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে আবেদনের জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়ার পাশাপাশি আবেদন বাছাই করতে হবে, লিখিত কিংবা মৌখিক পরীক্ষা হবে, নিয়োগ কমিটির সুপারিশ হয়ে পরিচালনা বোর্ডে উঠবে অনুমোদনের জন্য। বোর্ডের অনুমোদনের পর নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। কিন্তু এখানে বিজ্ঞপ্তি দিলেও বোর্ড সদস্যদের অধিকাংশই বিষয়টি জানতেন না।

তবে বোর্ড সদস্যদের বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন নিয়োগ কমিটির প্রধান ও হাসপাতাল পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক ডা. একেএম আজিজুল হক। তিনি আমার দেশকে বলেন, পদাধিকার বলে পরিচালক অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারেন। এখানে আমার কর্তৃত্বের কিছু নেই। নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে বোর্ড সদস্যরা মতামত দিয়েছেন। একাধিক সভা হয়েছে, সবার মতের ভিত্তিতে নিয়োগ হয়েছে। এখন তারা যদি কেউ বলে থাকেন যে নিয়ম মেনে হয়নি, তাহলে তারা তখন কেন প্রতিবাদ করেননি, নিয়োগের আগে কেন আপত্তি তোলেননি।

ডা. আজিজুল আরো বলেন, যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা এতদিন বিনা বেতনে কাজ করেছেন। কাজেই পরিচালকের একটা দায়বদ্ধতা তো রয়েছেই। শুরুতে ৪২ জন নিয়োগেরই কথা ছিল, পরে নতুন করে ৬৫ জনে উন্নীত করা হয়। সেটার জন্য আলাদা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি, বোর্ড সভা অনুমোদন দিয়েছে।

এদিকে নিয়োগে বঞ্চিত হয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন বঞ্চিত চিকিৎসকরা। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে অবৈধ দাবি করে আন্দোলন করেছেন বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টিপন্থিসহ বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকরা।

জামায়াতপন্থি চিকিৎসকরা গতকাল বৃহস্পতিবার শিশু হাসপাতালের সামনে এক মানববন্ধনে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে এভাবে চিকিৎসক নিয়োগ হতে পারে বেসরকারি হাসপাতালে। তবে সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে এমন নিয়োগ দেওয়া যায় না।

গত ৩০ জুন শিশু হাসপাতালের সামনে প্রতিবাদ মিছিল করেন বিএনপিপন্থি সংগঠন ডকটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে ড্যাবের নেতা অধ্যাপক হারুন আল রশিদ আমার দেশকে বলেন, ৮-১০ জন হলে মানা যেত, ৬৫ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই। ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ নীরবে নিয়োগ দিত, এখানেও তাই হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারেন, কিন্তু বিপুল সংখ্যক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না বলেই সব জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠছে। আমরা সবসময়ই চাই বিগত দিনে যারা নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছে, তারা অগ্রাধিকার পাক। কিন্তু এখনো যদি আওয়ামী লীগের মতোই গোপনে নিয়োগ দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে না আসতে পারি, তাহলে তো মুশকিল।

বঞ্চিতদের অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে আমরা হস্তক্ষেপ করতে চাই না। কিন্তু যে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, তার কিছুটা সত্যতা পাওয়ায় আমরা আমলে নিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছে। জবাব পেলে মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে তা নেওয়া হবে।

একই বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হয়েছে, সেটি জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জবাব পেলে যতটুকু করার আমরা করব।