
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অসংক্রামক রোগের ( হৃদরোগ , ডায়াবেটিস ইত্যাদি ) দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে । মৃত্যুর দুই - তৃতীয়াংশের বেশি ঘটছে বিভিন্ন অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে । তবে কয়েকটি সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবও জনস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে । বিশেষ করে মশা ও মাছিবাহিত এমন ছয়টি রোগ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে । জনস্বাস্থ্য এবং সেই সূত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে উঠছে এসব রোগ ।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন , মশাবাহিত রোগগুলো নিয়ে কয়েক দশকের সরকারি কার্যক্রমের সুবাদে কয়েকটি রোগ নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে । আবার কয়েকটি মহামারি আকার ধারণ করেছে । বর্তমানে ডেঙ্গু , চিকুনগুনিয়া , ম্যালেরিয়া , জাপানিজ এনকেফালাইটিস ও জিকা রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে দেশে । এর মধ্যে গত ছয় বছরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি । মাত্রায় এর পর রয়েছে ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়া । মশা নির্মূলে বিজ্ঞানসম্মত পন্থা অবলম্বন না করা , রোগের জিনভিত্তিক গবেষণার অনুপস্থিতি , অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার ঘাটতি মশাবাহিত রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে ।
মশা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় অলাভজনক সংস্থা আমেরিকান মসকিউটো কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের ( এএমসিএ ) তথ্যমতে, অন্য যেকোনো জীবের তুলনায় মশা মানুষের জন্য বেশি দুর্ভোগ সৃষ্টি করে । বিশ্বে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় মশাবাহিত রোগের কারণে । যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রামের ভাষ্য , বিশ্বে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে । এই দুই কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে , এর মধ্যে ১০০ প্রজাতির মশা মানবদেহে অন্তত ২০ টি প্রাণঘাতী রোগ ছড়াতে সক্ষম । বাংলাদেশে ঠিক কত প্রজাতির মশা রয়েছে তার নিশ্চিত তথ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে নেই ।
ফাইলেরিয়া
মশাবাহিত রোগগুলোঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( ডব্লিউএইচও ) , সরকারের রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণের তথ্য অনুযায়ী , বাংলাদেশে মোটা দাগে ছয়- সাতটি মশা ও মাছিবাহিত রোগ দেখা যায় । এগুলো হচ্ছে ডেঙ্গু , চিকুনগুনিয়া , ম্যালেরিয়া , জিকা , জাপানিজ এনকেফালাইটিস ও কালাজ্বর । বাংলাদেশে বিরল হলেও ওয়েস্ট নাইল জ্বরের সংক্রমণও শনাক্ত হয়েছে । এ দেশে এডিস মশা চিকুনগুনিয়া , ডেঙ্গু , লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস , জিকা ; অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশা ফাইলেরিয়াসিস , ম্যালেরিয়া ; কিউলেক্স মশা জাপানিজ এনকেফালাইটিস , লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস , ওয়েস্ট নাইল ফিভার ও ফাইলেরিয়া এবং স্যান্ডফ্লাই নামের এক প্রকার মাছি কালাজ্বরের বাহক হিসেবে কাজ করে ।
লিম্ফ্যাটিক
ডেঙ্গু : দেশে মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে এখন ডেঙ্গুর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে । শুরুর দিকে রাজধানী ঢাকায় সীমিত থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের সব অঞ্চলে বড় পরিসরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়েছে । ২০০০ সালে প্রথম এ রোগের নিয়মিত পরিসংখ্যান রাখতে শুরু করে সরকারের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ । ২০১৯ সালে শহর ও গ্রাম উভয় স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু । সে বছর লাখের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় । তাদের মধ্যে দেড় শর বেশি রোগীর মৃত্যু হয় । ২০০০ থেকে ২০২২ সাল — এ ২৩ বছরে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। এর মধ্যে মারা গেছে ৮৫০ রোগী । সর্বোচ্চ আক্রান্তের বছর ছিল ২০২৩। সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি রোগী । মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন । গত বছর ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন রোগীর বিপরীতে মারা গেছে ৫৭৫ জন । আর চলতি বছরের শুরু থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে
ভর্তি হয়েছে । মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের । ডেঙ্গুতে বাংলাদেশেই মৃত্যু সবচেয়ে বেশি , এমনটি জানা যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র ( ইসিডিসি ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( ডব্লিউএইচও ) তথ্য বিশ্লেষণে । এদের তথ্য বলছে , বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে । দেশটিতে গত বছর প্রায় ১ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে । এর মধ্যে মারা গেছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার । গত বছর রোগীর অনুপাতে ব্রাজিলে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ আর বাংলাদেশে ছিল শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ । চিকুনগুনিয়া : ডেঙ্গুর মতোই চিকুনগুনিয়াও ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে । রোগ দুটির উপসর্গে কিছু মিলও আছে । বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে । ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে কিছু রোগী পাওয়া যায় । এর পরের বছরগুলোতে কমবেশি সংক্রমণ দেখা গেছে । তবে ২০১৭ সালে দেশজুড়ে এ ভাইরাল রোগটি ছড়িয়ে পড়ে ।
গত বছরের ডিসেম্বরে আইইডিসিআর জানায় , দেশে জিকা ভাইরাসে ১১ জন এবং চিকুনগুনিয়ায় ৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছে । চলতি বছরেও চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে । গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৩৩৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫৩ জনের দেহে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর । ম্যালেরিয়া : ম্যালেরিয়াই সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত মশাবাহিত রোগ । স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায় । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে , ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ৬ লাখ ১ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে । এর মধ্যে মারা গেছে ৬৬৩ জন । চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ২ হাজার রোগী পাওয়া গেছে । আর মারা গেছে ১ জন । দুই দশক ধরে দেশে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকলেও গত তিন বছরে সংক্রমণ বেড়েছে ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা জানিয়েছে , সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় রোগটি নির্মূল করা যায়নি । চট্টগ্রাম , সিলেট , ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগের ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে । জেলাগুলো হলো কক্সবাজার , চট্টগ্রাম , বান্দরবান , রাঙামাটি , খাগড়াছড়ি , শেরপুর , কুড়িগ্রাম , ময়মনসিংহ , নেত্রকোনা , হবিগঞ্জ , সুনামগঞ্জ , সিলেট ও মৌলভীবাজার । তবে মোট ম্যালেরিয়া রোগীর দুই - তৃতীয়াংশই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার । গভীর জঙ্গলে অ্যানোফিলিস মশার প্রকোপ বেশি হওয়ায় পার্বত্য অঞ্চলে রোগী বেশি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবশ্য বলছে , আগের চেয়ে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ৭৯ শতাংশ কমেছে । মৃত্যুও কমেছে ৯১ শতাংশ ।
মশা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর জানিয়েছে , কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ ছড়াচ্ছে । গোদ রোগে জ্বর ও ঠান্ডা লাগে এবং জটিল হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যাপকভাবে ফুলে যায় । দেশের অন্তত ৩৪ টি জেলায় এ রোগ দেখা যাচ্ছে । কালাজ্বরের বাহক হিসেবে কাজ করে স্যান্ডফ্লাই নামের মাছি । দেশে ১৯৯৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেড় লাখ কালাজ্বরের রোগী পাওয়া গেছে । তবে বাংলাদেশ গোদ ও কালাজ্বর মোটের ওপর নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে ।
বাংলাদেশে প্রথম জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় । পরবর্তী সময়ে রাজশাহী , রংপুর , চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলেও রোগটি পাওয়া যায় । আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের মৃত্যু হয় বলে বৈশ্বিক বিভিন্ন জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা উল্লেখ করেছে । এই রোগের জন্য বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র ( সিডিসি ) । দেশে ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসবাহিত জ্বর ও জিকার সংক্রমণও শনাক্ত হয়েছে । তবে এই দুটি রোগ তেমন ছড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া যায়নি ।
কীটতত্ত্ব ও রোগতত্ত্ববিদেরা যা বলেন : বিশেষজ্ঞরা বলছেন , জলবায়ু পরিবর্তন , দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ , মানুষের চলাফেরা বৃদ্ধি , অনুপযুক্ত পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা , শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব ইত্যাদি মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে । জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ( নিপসম ) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড . মো . গোলাম ছারোয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন , ' এ ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে সে রকম কোনো গাইডলাইন নেই । মশা বা মাছিবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিকেল এন্টোমলজিস্টের প্রয়োজন । কিন্তু দেশে মেডিকেল এন্টোমলজিতে একাডেমিক ডিগ্রি প্রদানের প্রতিষ্ঠানই নেই । মেডিকেল এন্টোমলজির ওপর স্নাতকোত্তর চালুর জন্য আমরা চেষ্টা করছি । এসব সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণার জন্য উচ্চ প্রযুক্তির পরীক্ষাগারও প্রয়োজন ।’ মশা বা মাছিবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মশা নির্মূলে বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করা , গবেষণা এবং জনসম্পৃক্ততার তাগিদ দিলেন ড . ছারোয়ার ।
দেশে ফাইলেরিয়া ও কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণ করা গেছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ( রোগ নিয়ন্ত্রণ ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা . বে - নজির আহমেদ বলেন , ‘ কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকা মানে সেই রোগ নিয়ে কম সতর্ক থাকার সুযোগ নেই । ম্যালেরিয়া নিয়ে ব্যাপক কাজ হয়েছে বলেই রোগটি দেশে ১৩ জেলায় সীমাবদ্ধ । ' ডেঙ্গু ভবিষ্যতে দেশে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে উল্লেখ করে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন , “ কোনো দেশে এই রোগ একবার প্রবেশ করলে তা বের হয় না ।
গত ২৫ বছরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ধারেকাছেও যাওয়া যায়নি । বরং এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে । ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সঠিকভাবে কার্যক্রম চালানো হয়নি । এডিস মশা নির্মূল করা গেলে চিকুনগুনিয়াও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে । আর জাপানিজ এনকেফালাইটিস মারাত্মক রোগ । মস্তিষ্কে সংক্রমণ ছড়ায় বলে মৃত্যুহার অনেক বেশি । ’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ( রোগ নিয়ন্ত্রণ ) অধ্যাপক ডা . মো . হালিমুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ মশা বা মাছি নির্মূলের কাজ স্থানীয় সরকারের । আমরা স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি । এসব রোগের প্রকোপ বাড়লে স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর চাপ বাড়বে । বাহক বাহিত রোগের বাহক নির্মূলের জন্য শুধু কর্তৃপক্ষ নয় , জনগণেরও দায়িত্ব আছে । জনসম্পৃক্ততা ছাড়া এসব রোগের বাহক ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ নয় । '