Image description

লন্ডনে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূস এবং তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটি অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছিল দুই দিন আগেই। তবে দুই নেতার বৈঠকের সময় তাদের সম্মতি নিয়ে সেটি গণমাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।

সরকার ও বিএনপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র খবরের কাগজকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র বলছে, বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সৌজন্য ও ভদ্রতা দেখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যে পরবর্তী আলোচনা এগিয়ে নিতে দুই নেতার আর কোনো বেগ পেতে হয়নি। তাদের মধ্যে হয়নি কোনো বাগবিতণ্ডা বা দর-কষাকষিও। বরং আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে দুই নেতাই প্রাণবন্ত আলোচনায় মেতে ওঠেন। তারা আগামীতে দেশ থেকে দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধের পাশাপাশি হানাহানির রাজনীতি বন্ধ করতে সম্মত হন। তারা একমত পোষণ করেন, যেকোনো মূল্যে আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল রাখতে হবে। কারণ সংসদে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল না থাকলে সরকারের ভুলত্রুটি বেরিয়ে আসবে না। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সরকারের ভুল শুধরে নেওয়া কঠিন হবে। এ প্রসঙ্গে তারা গণ-অভ্যুত্থানে পদচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়কার সংসদের কথা উল্লেখ করেন। ওই সময় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বাইরে থাকায় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল না। ফলে আস্তে আস্তে শেখ হাসিনার সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত হয়েছিল। 

বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা উচিত- এমন আলোচনা দেশের রাজনীতিতে অনেক দিন ধরে আছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল মনে করে, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সরকারের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ফলে সংসদের ভেতরে ও বাইরে গঠনমূলক প্রতিবাদও গড়ে ওঠে না। বিএনপিও মনে করে, প্রতিবাদের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও সংসদে বিরোধী দল না থাকলে ‘পলাতক ফ্যাসিস্টরা’ দেশের বাইরে থেকে কথা বললে জনগণ তাদের কথাই শুনবে। তাই শক্তিশালী বিরোধী রাখার বিষয়ে বিএনপি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার পক্ষে। বিরোধী দলকে কোনো প্রকার বাধা দেওয়ার পক্ষে তারা নয়। 

ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের ‘দিকনির্দেশনা’ নিয়ে লন্ডনের অনানুষ্ঠানিক ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। 

ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রক্ষাকারী সূত্রগুলো বলছে, গত ১৩ জুন শুক্রবার ডরচেস্টার হোটেলের সেই বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণের বিষয়ে আলোচনা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, আগামী দিনের বাংলাদেশ কীভাবে চলবে সে বিষয়ে দুই নেতা তাদের মতামত তুলে ধরেন। তারা একমত পোষণ করেন যে যতদূর পারা যায় সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া একটি পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে তারা একমত হন। পাশাপাশি জুলাই সনদ ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণা করা হবে বলে তারা একমত পোষণ করেন। 

নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধের কারণে দেশের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশের নানা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে দুই নেতা পরস্পরকে সতর্ক থাকার কথাও বলেন। দেশের মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে, যা এই বৈঠকের পর দূর হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন। 

বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, তারেক-ইউনূস বৈঠক ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য ‘গেম ওভার’। তিনি লেখেন, ঐতিহাসিক এই বৈঠক ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য ‘শেষ পেরেক’।

বৈঠকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে দুই নেতা খোলামেলা আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডর, সেনাবাহিনী এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিষয়ে আলোচনায় ওঠে।

বৈঠকে ড. ইউনূসকে উদ্দেশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘আমার মা (খালেদা জিয়া) এবং আপনি এই দুজনই আমাদের মুরুব্বি। আপনাদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় আগামী দিনের বাংলাদেশ চলার পথ প্রশস্ত হতে পারে।’ দুই নেতার ঘনিষ্ঠজনরা খবরের কাগজকে আরও জানান, ‘আপনাকে আমরা ছাড়ছি না, ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে আপনার থাকতে হবে’- এমন কথা বলেছেন তারেক রহমান।

যদিও লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন-পরবর্তী সরকারে তিনি থাকছেন না। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো খবরের কাগজকে জানিয়েছে, নির্বাহী ক্ষমতার বাইরে থেকে ড. ইউনূসের নির্দেশনা ভবিষ্যৎ সরকারে কাজে লাগাতে চায় দলটি। তারা আশাবাদী, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে ‘ব্র্যান্ডিং’ করতে শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হবেন।

বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই নেতার মধ্যে অত্যন্ত আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয় বলে জানা যায়। ভবিষ্যতে যেকোনো সমস্যা আলোচনা করে সমাধান করবেন বলে আলোচনা হয়। 

বৈঠক থেকে বেরিয়ে উপস্থিত নেতা ও সরকারের কর্মকর্তাদের সামনে ড. ইউনূস তারেক রহমানের ভূয়সী প্রশংসা করেন বলে জানা যায়। ইউনূস জানান, এর আগে তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেননি বা বৈঠক করেননি। তবে বৈঠককালে মনে হয়েছে, তারেক রহমান অত্যন্ত অমায়িক ও ভদ্র একজন মানুষ। তিনি এতটাই ‘সজ্জন’ ব্যক্তি, যা তার ধারণার মধ্যে ছিল না বলেও উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কথা স্মরণ করেন তিনি। ইউনূস বলেন, তারা দুজনেই অসাধারণ মানুষ।