
বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে চীন। তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদীর ওপর এই মেগা-ড্যাম (বাঁধ) নির্মাণের উদ্যোগ শুধু নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিপ্লব ডেকে আনবে না, একইসঙ্গে এটি পরিবেশ ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞরা।
চীনের থ্রি গর্জেস ড্যামের চেয়েও উচ্চতায় বড় হতে যাওয়া এই প্রকল্প এখন বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একদিকে যেমন এটি চীনের শক্তিমত্তার প্রতীক হয়ে উঠছে, অন্যদিকে পরিবেশবাদী ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং সম্ভাব্য জনবিচ্যুতির বিষয়ে।
শক্তির নতুন পরাকাষ্ঠা: তিন গুণ বেশি ক্ষমতা
ইতোমধ্যেই নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে চীন বিশ্বের শীর্ষে। নতুন এই বাঁধের ধারণক্ষমতা হবে ৬০ গিগাওয়াট—যা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় থ্রি গর্জেস ড্যামের (২২ গিগাওয়াট) প্রায় তিনগুণ। তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো, যেটি বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার নদী, এর প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বিশাল জলাধারে পানি জমা করে টারবাইন ঘোরানোর মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
তবে এই প্রযুক্তিগত অর্জনের পেছনে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জও। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে এই হস্তক্ষেপ এর জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশী দেশগুলোর পানিসম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা।

ছবি: সংগৃহীত
জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য
বর্তমানে চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৬০ শতাংশই আসে কয়লা থেকে। ২০৬০ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্বন-মুক্ত বিদ্যুৎ খাত গড়ে তুলতে চায় বেইজিং। সেই লক্ষ্যেই এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে।
কয়লা পোড়ানো থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থার মাধ্যমে চীন একদিকে যেমন কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারবে, অন্যদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অবদান রাখবে, তবে এই রূপান্তর সফল করতে হলে পরিবেশগত প্রভাব ও নদীনির্ভর জনপদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে।

ছবি: সংগৃহীত
পরিবেশগত ও মানবিক আশঙ্কা
বিশাল এই প্রকল্পকে ঘিরে ইতোমধ্যেই পরিবেশবাদী সংগঠন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইয়ারলুং জাংবো নদীঘেঁষা অঞ্চলটি নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। ফলে বাঁধ নির্মাণের ফলে তাদের বাসস্থান হুমকির মুখে পড়বে।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে সম্ভাব্য জনবিচ্যুতি। ড্যামের কারণে প্রায় ১২ লাখ মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে হতে পারে। এর ফলে এসব জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, সংস্কৃতি ও জীবিকা বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইয়ারলুং জাংবো নদীই ভারতের অরুণাচল ও আসাম হয়ে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে এই প্রকল্প সরাসরি ভারত ও বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই আশঙ্কা করছে, চীন যদি নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে তীব্র খরার সময়ে পানির সংকট এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিলে বন্যার মতো দুর্যোগ তৈরি হতে পারে। যদিও চীন বলছে, তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর পানি অধিকার সম্মান করবে এবং পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে—তবুও সংশয় কাটছে না।
ভৌগোলিক রাজনীতির নতুন অধ্যায়
এটি শুধু একটি বাঁধ নয়, বরং চীনের প্রভাব বিস্তারের কৌশলের অংশ। বিশাল জলবিদ্যুৎ শক্তি এবং কৌশলগত অবস্থান চীনকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওপর একধরনের পানিসম্পদ-নির্ভর আধিপত্য দিতে পারে। ফলে ভারত-চীন উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে না পারলে, পানি-সংকটকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক বিরোধ জোরালো হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চীনের পদক্ষেপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
চীনের এই নতুন মেগা-ড্যাম প্রকল্প একদিকে যেমন নবায়নযোগ্য শক্তির ভবিষ্যতের পথে এক বড় পদক্ষেপ, অন্যদিকে এটি পরিবেশ, প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং লাখো মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।