
ঈদসহ অন্যান্য উৎসবে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পর্যটকদের কেনাকাটার প্রথা ছিল সে দেশের ব্যবসায়ীদের বড় আনন্দের একটি বিষয়। ভারতের কলকাতা, নিউ মার্কেট, মল্লিকবাজারসহ অন্য শপিং হাবগুলোয় প্রচুর বাংলাদেশি ক্রেতা ঈদের কেনাকাটা করতেন। কিন্তু, গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির প্রভাব পড়েছে এই কেনাকাটার ট্রেন্ডে। ফলে এবার ঈদবাজারকে কেন্দ্র করে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার (প্রায় ২৪ কোটি মার্কিন ডলার) বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশের। বিদেশে কেনাকাটার এই প্রবণতা সামনে আরো কমাতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশের বাজার আরো চাঙা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কালো টাকার প্রভাবেই ভারতমুখী ছিল বাংলাদেশিরা
বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে ঈদে যারা কেনাকাটা করতেন, তাদের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ইকোনমিস্ট ফোরাম। তাদের তথ্যমতে, প্রতি বছর রমজান মাসের শুরু থেকে ঈদ পর্যন্ত কমপক্ষে দেড় লাখ বাংলাদেশি কেনাকাটার জন্য ভারত যেতেন। এদের বেশিরভাগই বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের প্রথম ও মধ্যম পর্যায়ের নেতাকর্মী ছিলেন। এদের হাতে ছিল কালো টাকা। অবৈধ আয়ের দাপুটে নেতাদের জন্য ভারতের কলকাতা ছিল সহজ কেনাকাটার উৎস। ফলে সপরিবারে ছুটে যেতেন তারা।
গ্লোবাল ইকোনমিস্ট ফোরাম ভারতের ট্যুরিজম বিভাগের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, বছরে শুধু ঈদুল ফিতর উপলক্ষেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩০ কোটি ডলার যেত ভারতে। ফলে এই সময়ে বাংলাদেশের খোলা বাজারে ডলারের মূল্য বেড়ে যেত।
সংগঠনের সভাপতি ড. এনায়েত করিম আমার দেশকে বলেন, এ বছর একটি ভিন্ন ঈদবাজার দেখছেন ভারতের বিভিন্ন শপিংমলগুলোর বিক্রেতারা। ক্রেতাশূন্যতায় পড়েছে কলকাতার অনেক শপিংমল। অতীতেও বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় পোশাকের প্রতি একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সেখানকার কাপড়ের মান, ডিজাইন ও ফ্যাশন আরো আকর্ষণীয় মনে হতো। বাংলাদেশের পোশাক বাজারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড থাকলেও ঈদের মতো বিশেষ উৎসবে ভারতীয় পোশাক কেনার প্রবণতা ছিল বেশি।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে ড. করিম জানান, বিগত দেড় দশকে কালো টাকার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, কে কোথায় অর্থ ব্যয় করবে তার একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল। ওই সুযোগটি সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছিল ভারত। তারা বাংলাদেশিদের সহজ ভ্রমণ আর কেনাকাটার সব পথ খুলে দিয়েছিল। বিশেষ করে কলকাতার অর্থনীতি চাঙা হয়েছিল বাংলাদেশিদের টাকায়। কলকাতার নিউ মার্কেট, শ্রী লেদারস, বিগ বাজার ও অন্য শপিংমলগুলোতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ক্রেতার সমাগম ঘটত। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের ক্রেতাদের এই বাজারগুলোতে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল মান ও দামের ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্যকে অধিকতর সুবিধাজনক মনে করা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বিগত সময়ে বাংলাদেশ সরকারের নমনীয়তার সুযোগ আর ভারতে প্রবেশে সহজ পথ বাংলাদেশিদের কেনাকাটার হাব হয়ে উঠেছিল ভারত। তার হিসাবমতে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শপিংমলগুলোয় বছরে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা করতেন বাংলাদেশিরা। এবার সেই চাপ পড়েছে দেশের বাজারে। হেলাল উদ্দিন জানান, দেশের শপিংমলগুলোতেও ভারতীয় পোশাকের ছড়াছড়ি। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি পণ্যও আছে। তবে এবার এসব পণ্য যেহেতু বৈধ উপায়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, ফলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পাচ্ছে।
ঢাকার বাসিন্দা সৈয়দ নাজমুল হক বলেন, তিনি তার পরিবারকে খুশি করতে এবং ঈদ উপলক্ষে উপহার কিনতে গত বছর রমজান মাসে ভারতে গিয়েছিলেন। তার মতো অনেক বাংলাদেশি ক্রেতা ঈদের কেনাকাটার জন্য ভারতের শপিংমলে ছুটে যেতেন। তার মতে, ভারতীয় পোশাকের মান ও ডিজাইন বাংলাদেশি বাজারের তুলনায় অনেক ভালো এবং সস্তা মনে হয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ভারতীয় কাপড় কয়েক মাস ব্যবহারেই নষ্ট হয়ে যায়। মূলত ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনের কারণে সে দেশের বাজারে বাংলাদেশিদের ভিড় বলে মনে করেন তিনি।
হাসিনার আমলে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছিল ভারত
গত বছর ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার ঘোষণা দিয়েছিল। বিশেষ করে ঈদের আগে ভিসা পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত ক্যাম্প করা হয়েছিল। ফলে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি পর্যটক ভারতে ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন।
ভারতীয় দোকান মালিকদের মতে, ঈদ মৌসুমে প্রতি দশজনের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি ক্রেতা থাকতেন। ফলে ভারতের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ঈদ উপলক্ষে অনেক সুবিধা পেতেন। কিন্তু চলতি বছর রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বাংলাদেশি পর্যটকদের ভারতে যাওয়া প্রায় শূন্যের কোটায় নেমেছে।
এদিকে, ভারতের বাজারে বিশেষ ছাড় ও পণ্য সাশ্রয়ের সুযোগের কথা বলে বাংলাদেশি ক্রেতারা আগের চেয়ে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে শাড়ি, পাঞ্জাবি, চুড়িদার, গহনা ও পশমিনা শাল বাংলাদেশে পাওয়া না গেলেও ভারতে এসব পণ্য কিনতে পারতেন কিছুটা কম দামে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় বর্তমানে সেই প্রবণতা একেবারে কম।
৩ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, ঈদ, পূজা, বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশিরা বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেন ভারতের বাজারে। তিনি বলেন, যেহেতু ভারতের বাজারে এখন বাংলাদেশি ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে, এ কারণে এ বছর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন গ্লোবাল ইকোনমিস্ট ফোরামের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ড. দিলওয়ার সিং। তার হিসাবমতে, যদি একেকজন বাংলাদেশি গড়ে ৫০০ ডলারের পণ্য কিনতেন, তবে সে হিসাবেও বাংলাদেশ থেকে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসত ভারতে। কিন্তু বর্তমানে সীমান্তে উত্তেজনা, রাজনৈতিক বিভাজন ও ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে সেই অর্থ বাংলাদেশেই থাকছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধরনের স্বস্তি। তবে এর জেরে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছেন ভারতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম জানান, তার জন্য বিদেশি বাজারে কেনাকাটা করা এক ধরনের অভ্যস্ততা ছিল। কিন্তু এবারের ঈদে তিনি ভাবছেন ভারতে যাওয়ার পরিবর্তে দেশে উপলভ্য বিভিন্ন শপিংমলে কেনাকাটা করবেন। এটা আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ভারতে গিয়ে কেনাকাটা এখন অসম্ভব।
বন্ধ সহজ ভ্রমণ ভিসা, কমেছে ফ্লাইট
বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফ্লাইটের সংখ্যা কমে যাওয়াও এ পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। আগে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার বাংলাদেশি পর্যটক ভারতে যেতেন ভ্রমণ ও কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এখন ভারতগামী ফ্লাইটের সংখ্যা কমে গেছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। বিশেষ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও অন্যান্য বিমান সংস্থা কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য শহরের উদ্দেশে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করলেও বর্তমানে সেসব ফ্লাইটের সংখ্যা কমে গেছে। বিশেষ করে কলকাতায় গন্তব্যের ফ্লাইটের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে অনেকেই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্য দেশে যাচ্ছেন, যেখানে ভ্রমণ সহজ ও সস্তা।
ভারতীয় দোকান মালিকদের ক্ষতি
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এখন সংকটে পড়েছেন। কারণ ঈদ মৌসুমে বাংলাদেশের ক্রেতাদের কমে যাওয়ায় তাদের বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে। শুধু যে বাংলাদেশিরা কেনাকাটার জন্য ভারত যেতেন সেটিও নয় দাবি করে কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকার একটি দোকানের মালিক পঙ্কজ জানান, প্রতিদিন তার দোকানেই অন্তত ৫০ থেকে ১০০ জন বাংলাদেশি কেনাকাটার জন্য যেতেন। তারা আসতেন চিকিৎসার জন্য। তিনি জানান, ঈদের আগে বাংলাদেশিদের ঢল নেমেছিল গত বছর। রোজার শুরু থেকেই প্রচুর বাংলাদেশি পর্যটক পেয়েছিলেন তিনি, যারা কেনাকাটার জন্য গিয়েছিলেন। এবার তার উল্টো চিত্র। পঙ্কজ আরো জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর অন্তত ৯০ ভাগের কম পর্যটক পাচ্ছেন ভারতের দোকানিরা।
বাংলাদেশি বাজারের ঝুঁকছেন ক্রেতারা
বাংলাদেশের বাজারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দোকান মালিকরা কীভাবে পণ্য, দাম ও গ্রাহকসেবা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবেন, তার ওপর। ভারতের বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে যদি পোশাকের দাম আরো প্রতিযোগিতামূলক হয় ও সেবার মান আরো উন্নত হয়, তবে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারও শৌখিন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারবে। তবে এখনো বেশকিছু দোকান মালিক চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন, বিশেষ করে ঈদ ও অন্যান্য বড় উৎসবে ভারতে শপিং করতে যাওয়া বাংলাদেশিদের কারণে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণে রাতদিন মাঠে কাজ করি। অথচ বাংলাদেশি বিত্তশালীরা যদি বিদেশে কেনাকাটায় ঝুঁকে পড়েন, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা যা আসবে তা আবার ভিন্ন হাত ঘুরে চলে যাবে। তিনি মনে করেন, বিদেশে কেনাকাটার প্রবণতা বন্ধ করা উচিত।
বাংলাদেশি দোকানদার আবু নোমান বলেন, ‘এটি খুবই ভালো খবর যে, বাংলাদেশিরা ভারতে যাচ্ছে না। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এ থেকে উপকৃত হবেন। তবে দেশপ্রেম থাকা দরকার। কেনাকাটা কেন বিদেশে গিয়ে করতে হবে? আমাদের দেশে অনেক ভালোমানের পণ্য রয়েছে, সেগুলোই কেনা উচিত।’
উম্মে সালমা পারভীন নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আগে আমি ভারতীয় শাড়ি কিনতাম। তবে এখন আর কিনব না। আমার দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছে। কেন বিদেশের পণ্য কিনব, যখন আমাদের দেশের পোশাকশিল্পও সমৃদ্ধ। আমি এখন বাংলাদেশি শাড়িতে আনন্দ পাই।’
মৌসুমী আক্তার নামে এক শিক্ষিকা বলেন, ‘প্রথমে আমি ভারতীয় পণ্য কিনতাম। কিন্তু এখন বাংলাদেশি পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেশের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের দেশের পণ্য কেনার মধ্যে অনেক গর্বের অনুভূতি রয়েছে।’
কেন ভারতে শপিং করতেন বাংলাদেশিরা
বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতে কেনাকাটা করার প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রচার। ভারতের শাড়ি, পাঞ্জাবি, কসমেটিক্স, গহনা এবং বিশেষ করে পশমিনা শালসহ বিভিন্ন পণ্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছে শুধু প্রচারের কারণে। সেই সঙ্গে বিগত সময়ে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে একপেশে সুবিধা দিয়েছে। তবে এবার এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশিরা এখন আর ভিসা পাচ্ছেন না। এটি দেশের জন্যই ভালো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।