
আন্দোলন-সংগ্রাম আর মূল দল গোছানোর পাশাপাশি এবার পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দিকে নজর দিয়েছে বিএনপি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পন্থায় সবার মতামত তথা কাউন্সিলের মাধ্যমেই নতুন কমিটি গঠনে জোর দিচ্ছে দলটি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দলের অভ্যন্তরে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণ গণতন্ত্র চর্চাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবী দুটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে বিএনপি। এ দুই সংগঠন হলো অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স-বাংলাদেশ (অ্যাব) এবং অ্যাগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (অ্যাব)।
এ ছাড়া বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) নতুন কমিটি গঠনে কাউন্সিলের পথে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে ড্যাবের কমিটি গঠনের বিষয়ে বেশকিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূল দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মতোই পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করতে চান তারেক রহমান। এসব পেশাজীবী সংগঠনের নতুন কমিটিতে কোনো বিশেষ নেতার অনুসারীর পরিবর্তে সাবেক ছাত্রনেতা, তরুণ এবং ত্যাগীদের নেতৃত্বে আনার চিন্তা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। রোজার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নতুন কমিটির ঘোষণা আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, যেসব সংগঠনের মেয়াদ শেষ, সেগুলো নতুনভাবে হালনাগাদ করা হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারাও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে থেকে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, তিনি সেটি নেবেন।
দুই সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত : গত ৪ মার্চ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু এবং মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হাছিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স-বাংলাদেশের (অ্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। খুব দ্রুত অ্যাবের কমিটি ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া আহ্বায়ক রাশিদুল হাসান হারুন এবং সদস্য সচিব ড. মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (অ্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। খুব দ্রুত অ্যাবের কমিটি ঘোষণা করা হবে। প্রকৌশলী অ্যাবের কমিটি নিয়ে আলোচনা ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর অ্যাবের দুই বছর মেয়াদি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নির্বাচন-২০২২ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রত্যক্ষ ভোট দিয়ে অ্যাবের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেন সংশ্লিষ্ট ভোটাররা। এতে সভাপতি পদে ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু এবং মহাসচিব পদে ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হাছিন আহমেদ নির্বাচিত হন। বিএনপির কেন্দ্রীয় সূত্র জানায়, রোজার শেষের দিকে অ্যাবের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।
এবারের কমিটিতেও পুরোনো কমিটির বেশ কয়েকজনকে শীর্ষ পদে রেখে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হতে পারে। ফলে নতুন কমিটির শীর্ষ পদের জন্য ঘুরেফিরে কয়েকজনের নাম আলোচিত হচ্ছে। এসব নেতা হলেন—সাবেক মহাসচিব প্রকৌশলী আলমগীর হাছিন আহমেদ, সিনিয়র সহসভাপতি প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল, সহসভাপতি প্রকৌশলী মো. মোস্তফা-ই জামান সেলিম, প্রকৌশলী সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব একেএম আসাদুজ্জামান চুন্নু, প্রকৌশলী মাহবুব আলম অন্যতম। এ ছাড়া প্রকৌশলী আ ন হ আখতার হোসেন, প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম তুহিনের নামও শোনা যাচ্ছে। অ্যাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম রিজু বলেন, দেশের ক্রান্তিকালে এবং বিএনপির দুঃসময়ে তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাজীবীদের পাশে থাকার পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামেও সক্রিয় থেকেছেন। তিনি অ্যাবের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করে বলেন, যারাই অ্যাবের দায়িত্বে আসবেন, তারা যেন আরও ভালো কিছু করেন এই প্রত্যাশা।
কৃষিবিদ অ্যাবের কমিটিতে নতুনদের আনার চিন্তা জানা গেছে, জাতীয়তাবাদী কৃষিবিদদের সংগঠন অ্যাগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (অ্যাব) আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। কৃষিবিদ রাশিদুল হাসান হারুনকে আহ্বায়ক, গোলাম হাফিজ কেনেডিকে যুগ্ম আহ্বায়ক ও জি কে মোস্তাফিজুর রহমানকে সদস্য সচিব করে তিন মাসের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির লক্ষ্য ছিল ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তারা নির্বাচনের পথ পরিহার করে সংগঠনের গণতান্ত্রিক পথযাত্রাকে রুদ্ধ করে। ফলে প্রাণচাঞ্চল্য হারায় জাতীয়তাবাদী কৃষিবিদদের সংগঠনটি। গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদী কৃষিবিদরা উক্ত আহ্বায়ক কমিটিকে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাবের নতুন কমিটি করা হবে একেবারে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ত্যাগী ও নতুনদের সমন্বয়ে। অ্যাবের নতুন কমিটির শীর্ষ পদের জন্য আলোচনায় আছেন কৃষিবিদ ড. আব্দুল করিম, হাসান জাফির তুহিন, শাহাদাত হোসেন চঞ্চল, শামীমুর রহমান শামীম, শফিউল আলম দিদার, মো. এমদাদুল হক দুলু, ড. আকিকুল ইসলাম আকিক, শাহাদাত হোসেন বিপ্লব, শফিকুল ইসলাম শফিক, রফিকুল ইসলাম খান ডন, ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, যুবদল নেতা কৃষিবিদ সানোয়ার আলম, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ মো. সোহরাব হোসেন সুজন, কৃষিবিদ শফিকুর রহমান নোবেলসহ কয়েকজন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।
কাউন্সিলের পথে এগোচ্ছে ড্যাব জানা গেছে, বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) কাউন্সিলের পথে এগোচ্ছে। দীর্ঘ আঠারো বছর পর ২০১৯ সালের ২৪ মে কাউন্সিলের মাধ্যমে বর্তমান কমিটি গঠন করা হয়। ড্যাবের ওই কাউন্সিলে শীর্ষ পাঁচটি পদের বিপরীতে দুটি প্যানেলের ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। দুটি প্যানেলের একটি হচ্ছে হারুন-সালাম, অন্যটি হচ্ছে স্বপন-বাচ্চু প্যানেল। ঢাকা-স্যার সলিমুল্লাহ-ময়মনসিংহ-সিলেট-রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সাবেক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত প্রথম প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন সভাপতি পদে অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ, সিনিয়র সহসভাপতি পদে ডা. মো. আব্দুস সেলিম, মহাসচিব পদে ডা. মো. আব্দুস সালাম, কোষাধ্যক্ষ পদে ডা. মো. জাহিরুল ইসলাম শাকিল এবং সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে ডা. মো. মেহেদী হাসান। দ্বিতীয় প্যানেলের সভাপতি পদে অধ্যাপক ডা. মোস্তাক রহিম স্বপন, সিনিয়র সহসভাপতি পদে ডা. বি গণি ভূঁইয়া, মহাসচিব পদে অধ্যাপক ডা. এসএম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, কোষাধ্যক্ষ পদে ডা. সাইফুদ্দিন নেসার আহমেদ তুষান এবং সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে তৌহিদুল ইসলাম জন। তবে প্রথম প্যানেল বিজয়ী হয়। এদিকে ড্যাবের বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ লক্ষ্যে গত ৪ মার্চ ড্যাবের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ড্যাবের ওই সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা। নির্বাচন কমিশনে চিকিৎসক বাদে অন্য পেশা থেকে তিন-পাঁচজন থাকবেন।
৫ আগস্টের আগে যারা সদস্য ছিলেন, কেবল তারাই ভোটার হবেন। ছবি সংবলিত ভোটার তালিকা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর বর্তমান কমিটি শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। তপশিল ঘোষণার পর যারা প্রার্থী হবে, তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে হবে। এ ছাড়া সভাপতি, সিনিয়র সহসভাপতি, মহাসচিব, কোষাধ্যক্ষ এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এই পাঁচ পদ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার ছয় সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকায় ছবি সংযুক্ত না করলে চূড়ান্ত ভোটার হওয়া যাবে না।
জানা যায়, এবারও ড্যাবের নতুন কমিটি হলে শীর্ষ পদের জন্য আলোচনায় আছেন ডা. হারুন আল রশিদ, ডা. মো. আব্দুস সালাম, ডা. জহিরুল ইসলাম শাকিল, ডা. মো. রফিকুল ইসলাম, ডা. মো. মেহেদী হাসান, ডা. আবুল কেনান, ডা. শাহ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ, ডা. পারভেজ রেজা কাকন, ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম, ডা. শেখ ফরহাদ, ডা. শাকুর খান। জানতে চাইলে ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ কালবেলাকে বলেন, বিএনপির দুঃসময়ে আমরা চিকিৎসকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে ড্যাবের দায়িত্ব গ্রহণ করি। যে সময় মহামারি করোনায় বিশ্ব বিপর্যস্ত ছিল। সে সময় দায়িত্ব নিয়েই আমরা দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি করোনাভাইরাস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মাঠে নিরলসভাবে সক্রিয় ছিলাম। ড্যাবের নেতাকর্মীরা সেসবের মূল্যায়ন করবেন ইনশাআল্লাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে সদস্য সচিব করে ড্যাবের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। এরপর প্রথম দশ বছরের মধ্যে চারটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ড্যাবের দায়িত্বে আসেন বেশ কয়েকজন নেতা। এর মধ্যে সর্বশেষ এমএ আজিজ ও এজেডএম জাহিদের নেতৃত্বে চলছিল ড্যাব। দেড় যুগ পর ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আজিজ-জাহিদ কমিটি বিলুপ্ত করে ডা. ডোনারকে আহ্বায়ক করে ১৬১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে ২০১৯ সালের ২৪ মে কেন্দ্রীয় সম্মেলন সম্পন্ন করে নবনির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে।